৫ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির সঙ্গীতশিল্পী কন্যা

‘সেই বছর (১৩০৯ সাল) আমার ছোট বোন হাসি (সুজাতা) জন্মায়। আমার তখন আট বছর বয়স’- বলেছেন পূর্ণিমা দেবী (চট্টোপাধ্যায়)। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমোদকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সুজাতা দেবীর জন্ম জোড়াসাঁকোয় ভাদ্র মাসের এক ভোরবেলায়। মেজদিদি পূর্ণিমা দেবীর কাছে তাঁর শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে। পূর্ণিমা দেবীর স্মৃতিকথায় আছে, সুরাজ বলে দাসী ছিল, নবুকে মানুষ করেছিল, সেই পরে হাসিকেও মানুষ করে। ...আমি তখন বড় হয়েছি, হাসিকে নিয়ে থাকতুম। …ও বোতলে দুধ খেত, বড় হয়েও বোতল ছাড়েনি। …বোতল ছাড়া ওর আর কোনো উৎপাত ছিল না’। তবে এই শান্ত মেয়েটিই ছোট বয়েসে একবার নাকে বোতাম ঢুকিয়ে ফেলেছিল। গগনেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে নাকে কাঠি ঢুকিয়ে বোতাম বের করে এনেছিলেন।

ছোট থেকেই চমৎকার গানের গলা ছিল সুজাতার। একবার ১১ই মাঘে পূর্ণিমা দেবী এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির আপত্তিতে ৬ নম্বর বাড়িতে যেতে পারলেন না। ৬ নম্বর বাড়ি অর্থাৎ মহর্ষিদেবের পরিবার ছিল ব্রাহ্ম। তাই গোঁড়া হিন্দু পরিবার তাদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করত না। মাঘোৎসবে না যেতে পেরে পূর্ণিমা দেবী- '১১ই মাঘের গানের স্বরলিপি দেখে, কনকদাদার ঘরে অর্গ্যান ছিল তাতেই গান বাজিয়ে অভ্যাস করছিলুম। হাসি তখন ছ-সাত বছরের হবে। সে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বাজনা শুনে গাইতে শেখে’।

এরপর একদিন হাসি ৫নম্বর বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনমনে গান গাইছিলেন তা শুনতে পেলেন গগনেন্দ্র-সমরেন্দ্র-অবনীন্দ্রদের মা, সৌদামিনী দেবী। তিনি সবসময় কারো গুণ থাকলে তাকে উৎসাহ দিতেন। সুজাতার গান শুনে তিনি তাকে ডেকে গাইতে বললে লজ্জাশীলা বালিকা কিছুতেই গাইল না। তখন সৌদামিনী দেবী গগনেন্দ্রনাথকে ডেকে বললেন, 'তোর ছোট মেয়ের খুব সুন্দর গানের গলা হয়েছে। ওকে শ্যামসুন্দরের কাছে দে গান শিখতে’। শ্যামসুন্দর ছিলেন ৫ নম্বর বাড়ির নিজস্ব গাইয়ে।

বিদ্যাসাগরের পুত্রের দৌহিত্র সরোজকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুজাতা দেবীর বিবাহ হয়। সুজাতার বিয়ের আগে গগনেন্দ্রনাথ একবার সাহেবদের পার্টি দিয়েছিলেন। সেখানে সুজাতা ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা’ গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। পূর্ণিমা দেবী বলেছেন, ‘সাহেবরা ওর গান শুনে একেবারে মোহিত হয়ে যায়’।

শিল্পী গগনেন্দ্রনাথের কন্যা বাবার গুণও কিছু পেয়েছিলেন। চমৎকার কনে সাজাতেন তিনি। তাঁর কনে সাজানোর গুণে কত সাধারণ চেহারার মেয়ের রূপ যেত খুলে। ‘আমাদের পরিবারের ভিতর যারই বিয়ে হত, ওর ডাক পড়ত কনে সাজাতে। এমনকি বাইরের বন্ধুবান্ধবেরাও কনে সাজানোর জন্য ডেকে নিয়ে যেত’। এমনই ছিল সুজাতার সাজানোর খ্যাতি। সেলাই আর আলপনার জন্যও তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন।

সুজাতা দেবী ও সরোজকুমার মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান সঞ্জয়কুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটবেলায় একবার টাইফয়েড হয়। তখনকার দিনে টাইফয়েডে নানারকম বিধিনিষেধ মানতে হত। এমনকি সেরে ওঠার পরেও মেনে চলতে হত নানান নিয়মকানুন। তাই তাকে ভুলিয়ে রাখার জন্য গগনেন্দ্রনাথ বানিয়ে বানিয়ে নানারকম গল্প বলতেন। সেইসব গল্প নিয়েই তৈরি হয় 'দাদাভাইয়ের দেয়ালা’। পরবর্তীতে মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় যার নামকরণ করেন 'ভোঁদর বাহাদুর’। জোড়াসাঁকো বাড়িতে কিন্তু ভোঁদর ছিল। রাতে ছাতে তারা পরম আনন্দে দাপাদাপিও করত। সেই ভোঁদরকে মনে রেখেই এই কাহিনি কিনা কে জানে! তবে গগনেন্দ্রনাথের নিজস্বতা এই কাহিনির প্রতিটি ছত্রে প্রকাশিত।

সুজাতা দেবী নিজেও গগনেন্দ্রনাথের অন্য একটি সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। গগনেন্দ্রনাথ একাধিকবার রাঁচি বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর থাকতেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও সেখানে বাড়ি করেছিলেন। সেকালে অনেকেই রাঁচিতে শরীর সারাতে যেত। শেষ যে বার গিয়েছিলেন, সে বার পূর্ণিমা দেবীও ছিলেন সঙ্গে। রাঁচির বাড়িতে গাড়িবারান্দার আর্চের ভিতর থেকে গগনেন্দ্রনাথ বাইরের দৃশ্য আঁকতেন। ‘একদিন সন্ধেবেলা শার্শির পিছনে আলোর সামনে আমাকে ও হাসিকে বসিয়ে শার্শিতে আমাদের ছায়া দেখে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। দু বোনের ছবি প্রায় একই রকম। দুটোকে পাশাপাশি রাখলে সহজে বোঝা যেত না কোনটা কার’- জানিয়েছেন পূর্ণিমা দেবী। সুজাতা দেবীর ছবিটা দাঙ্গার সময় নষ্ট হয়ে গেলেও পূর্ণিমা দেবীরটা ছিল।

রাঁচিতেই গগনেন্দ্রনাথের অসুখের সূত্রপাত হয়। সেই বছরেই শীতের সময় একদিন ভোর চারটের সময় বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে পড়ে যান। চিকিৎসায় সেরে উঠলেও বাকরুদ্ধ হয়ে যান। এর পরে তিনি দশ বছর বেঁচে থাকলেও ছবি আঁকতেও আর পারেননি, পারেননি কথা বলতেও। এই সময়ে সুজাতা দেবী গগনেন্দ্রনাথের খুব সেবা করেছিলেন। ডাক্তার তাঁকে মুরগির স্যুপ, মাংস ইত্যাদি খেতে বলেছিল। তখন ৫ নম্বর বাড়ির অবস্থা আগের মতো ছিল না। বাবুর্চিও ছিল না। সুজাতাই ইলেকট্রিক স্টোভে রান্না করে দিতেন। অবনীন্দ্রনাথ ‘বীটনস্ কুকারি বুক’ নামের বিদেশি রান্নার বই বার করে দিয়েছিলেন। যা যা খেতে চাইতেন গগনেন্দ্রনাথ সুজাতা সেই বই দেখে করে দিতেন। চিরদিনই তিন ভাই রাত্রে বিলিতি রান্নাই খেতেন, তাই সুজাতার হাতের রান্না খেয়ে খুব খুশি হতেন।

সুজাতা দেবীর নিজের বাড়ি ছিল পার্কসার্কাসে। শরীর একটু ঠিক হলে গগনেন্দ্রনাথ সেখানে যেতেন। তাঁর নিজের আঁকা ছবি দিয়ে তিনি ছোট মেয়ের বাড়ি সাজিয়ে দিয়েছিলেন। দাঙ্গার সময় সেই সব ছবি নষ্ট হয়ে যায়।

সুজাতার হাতের কাজ ছিল বড় সুন্দর। পানমশলা দিয়ে তিনি অপূর্ব সুন্দর বাড়ি বানাতেন। বানাতেন সেতার, সরোদ, হারমোনিয়ামও। শর্মিলা ঠাকুরের বিয়েতে পানমশলার ক্রিকেট টিম তৈরি করে দিয়েছিলেন। ফেলে দেওয়া তুচ্ছ জিনিষ দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ বানিয়েছিলেন কত কিছু! কে জানে 'ছোটকাকা'র সেই শিল্প সুজাতাকেও প্রভাবিত করেছিল কি না! সুজাতার তৈরি আইসক্রিম কাঠির বাড়ি, শিশিবোতলের পিনকুশন, নুনদান, পুতুল যে দেখেছে সেই মুগ্ধ হয়েছে। লেখালেখি তেমনভাবে না করলেও গগনেন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটির উদ্যোক্তাদের অনুরোধে লিখেছিলেন তাঁর বাবার কথা- ‘দার্জিলিংয়ে দেখেছি বাবা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। শিল্পীর চোখে তিনি যা দেখেছিলেন আমাদেরও তাই দেখতে শেখালেন। ….. তিনি আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিলেন’। এখানেই গগনেন্দ্র- অবনীন্দ্রনাথদের সার্থকতা। তাঁরা শুধু নিজেরা শিল্পী ছিলেন তাই নয়, অন্যদেরও দীক্ষিত করতে চেয়েছেন শিল্পে। শেখাতে চেয়েছেন দৈনন্দিনের মধ্যে রূপকে খুঁজে নিতে।

অবনীন্দ্রনাথ বনসাই করতে জানতেন। পূর্ণিমা দেবীকে শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ কি ভাবে গাছ ছোট করতে হয়। বলেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, ‘খুব ছোট জায়গায় মাটি বেশি না দিয়ে গাছ পুঁতবি। যে গাছ শিগগির মরে না, তেমন তেঁতুল, বট কিম্বা অশ্বত্থ গাছ, টবে পুঁতে জল দিবি। আর ডগায় নতুন পাতা বের হলে নখে করে ছিঁড়ে দিবি। তা হলে গাছ আর বাড়বে না’। পূর্ণিমা দেবী চেষ্টা করেও পারেননি। সুজাতা দেবী কিন্তু বনসাই বানাতে জানতেন। বটগাছের এক আশ্চর্য বনসাই করেছিলেন তিনি। ঝুরি নামিয়ে সেই বট দাঁড়িয়েছিল পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ কন্যার মতো সুজাতা দেবীও আত্মপ্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না। সীমায়িত গন্ডির বাইরে আজ তিনি তাই সম্পূর্ণ বিস্মৃত।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...