ঠাকুরবাড়ির এক অনন্যা: সুদক্ষিণা দেবী


মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান সুদক্ষিণা দেবীর জন্ম ১৮৮৪ সালের ১৩ই মে। তাঁর জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই হেমেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু ঘটে। লরেটোর ছাত্রী সুদক্ষিণা তথা পূর্ণিমা দেবীর বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, সংস্কৃত, উর্দু, হিন্দি, ফরাসি ইত্যাদি ভাষায় দখল ছিল। হেমেন্দ্রনাথের অন্যান্য কন্যা দের মত তিনিও একাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন। বিশেষত পিয়ানো ও বেহালা বাদনে তিনি দক্ষ ছিলেন। এই দুই বাজনায় তিনি কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের পরীক্ষা সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

সুদক্ষিণা দেবী ছিলেন প্রথম সম্ভ্রান্ত বাঙালি মহিলা তিনি বিবাহ সূত্রে পরাধীন ভারতের যুক্তপ্রদেশের অধিবাসী হয়েছিলেন। তাঁর স্বামী পন্ডিত জ্বালাপ্রসাদ পান্ডে ছিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পদাধিকারী এবং হরদই-র কমিশনার। ১৯০৩ সালে তাঁদের বিবাহ হয়। বিয়ের পর তিনি পূর্ণিমা জ্বালাপ্রসাদ দেবী নামেও পরিচিত ছিলেন।

আই সি এস জ্বালাপ্রসাদ তাঁর স্ত্রী-কে ঘোড়ায় চড়তে এবং বন্দুক চালাতে শিখিয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে সুদক্ষিণা ছাড়া এই দুটি গুণ আর কারও ছিল বলে জানা যায় না। নিছক বন্দুক চালান নয়, সুদক্ষিণা শিকার করতেও ছিলেন পটু। স্বামীর অকালমৃত্যুর পর সাহজাহানপুরে তিনি ‘পন্ডিত জ্বালাপ্রসাদ কন্যা পাঠশালাʼ স্থাপন করেন। সেদিনের যুক্তপ্রদেশে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার প্রচার তেমন ছিল না, সেখানে সুদক্ষিণা

মুজাফফরনগরে মেয়েদের জন্য স্কুল এবং এই দু'জায়গায় ‘পর্দা ক্লাব’ তৈরি করে পর্দানশীন মেয়েদের জীবনে একটু আলো আনার চেষ্টা করেছিলেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে বিধবা হবার পর সুদক্ষিণা প্রবল দাপটে জমিদারি সামলেছেন,নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। এই সব কাজ এবং মেয়েদের শিক্ষার জন্য তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারনেই তিনি কাইজার–ই–হিন্দ পদক লাভ করেছিলেন।

ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। তাই বন্দুক চালানো কিম্বা অশ্বারোহণের পাশাপাশি তিনি যে কলমও ধরবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ‘পুণ্য’ পত্রিকার পাতায় সুদক্ষিণা রান্নার একাধিক প্রণালী শিখিয়েছেন। শ্বশুরবাড়ির দেশের রন্ধনশিল্প বাপের বাড়ির দেশের পত্রিকায় তুলে ধরেছেন। লক্ষ্ণৌ পোলাও, আমের লক্ষ্ণৌ মোরব্বা, আনারসের লক্ষ্ণৌ মোরব্বার পাশাপাশি চকোলেট তৈরির প্রণালীও শিখিয়েছেন তিনি। লিখেছেন হিন্দিতেও।

সেদিনের বাংলাদেশে অথবা আজকের বাংলায় সুদক্ষিণা দেবী কতজনের চেনা? কিন্তু উত্তর প্রদেশে তাঁর জমিদারি সীমাতে তো বটেই এমনকি তার বাইরেও তাঁর জনপ্রিয়তা কম ছিল না। পরাধীন দেশে নিতান্ত অল্পবয়সে বিধবা হয়েও তিনি পুত্রকে মানুষ করেছেন, জমিদারি সামলেছেন, প্রজাদের জন্য কল্যাণমূলক কাজ, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য চেষ্টা করেছেন সুদূর উত্তরপ্রদেশে। যা আদৌ সহজ ছিল না। যা অবশ্যই ব্যতিক্রমী। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাইরের জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ৮৮ বছর বয়সে সুদক্ষিণা দেবী প্রয়াত হন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...