রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট' উৎসর্গ করেছিলেন সৌদামিনী দেবীকে। উৎসর্গ পত্রে দিদি সম্বোধনে তিনি লিখেছিলেন,”কাছে থাকি দূরে থাকি দেখ আর নাহি দেখ/শুধু স্নেহ দাও। স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘বিদ্রোহ' নামক ঐতিহাসিক উপন্যাসের উৎসর্গ পত্রটিতেও ‘দিদি' লিখে লেখা হয়েছে - ‘নিষ্ঠুর পরশে ম্লান বোঁটা ভাঙ্গা ফুল-/তবুও সুবাসে তার জগৎ আকুল/তবুও বিমল-শুভ্র স্নিগ্ধরূপ - জ্যোতি/জাগায় হৃদয়ে পুণ্য তোমারি মুরতি।' এই স্নিগ্ধ স্নেহপ্রবণতা সৌদামিনী দেবীর চরিত্র বৈশিষ্ট্য।
বেথুন স্কুলের প্রথম কয়েকজন ছাত্রীর অন্যতমা সৌদামিনী বাংলা ও ইংরেজি যথেষ্ট ভালো জানতেন। তাঁকে লেখা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দুটি চিঠিতে ইংরেজি উদ্ধৃতি আছে। সেই ইংরেজি সৌদামিনীর কাছে দুর্বোধ্য নয় তা জানতেন মহর্ষি। লেখার হাতখানিও যে তাঁর কতখানি সরস তার প্রমাণ আছে মহর্ষির প্রয়াণের পরে লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’-তে। প্রবাসীতে প্রকাশিত সেই লেখায় ঘরোয়া মহর্ষির অপরিচিত এক ছবি ধরা পড়ে। জোড়াসাঁকো বাড়িতে একটি পারিবারিক অভিনয়ে ‘তাঁহার একটি নাৎবৌ পুরুষ সাজিয়াছিলেন ও সেই সজ্জায় তাঁহাকে সুন্দর দেখিতে হইয়াছিল শুনিয়া তিনি হাসিতে লাগিলেন।' দেবেন্দ্রনাথের এই হাস্যময় রূপ আর কারো কাছে প্রকাশিত ছিল বলে মনে হয় না।
১৮৪৭ সালে জোড়াসাঁকোয় সৌদামিনী দেবীর জন্ম। তিনি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ষষ্ঠ সন্তান ও প্রথমা কন্যা।দেবেন্দ্রনাথের কন্যাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই অল্পদিন হলেও স্কুলে পড়েছিলেন। মহর্ষি একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ’আমি বেথুন সাহেবের বালিকা-বিদ্যালয়ে সৌদামিনীকে প্রেরণ করিয়াছি, দেখি এ দৃষ্টান্তে কি ফল হয়। তাছাড়া বাড়িতেও একজন ‘‘খৃষ্টান শিক্ষয়িত্রী’’ ও অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর কাছে নিয়মিত পড়াশোনা করেছেন। মহর্ষিও তাঁদের পড়াতেন।
পিরিলি বলে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সহজে বিয়ে হত না। বিয়ের পরেও অনেকেই স্বামীসহ পিতৃগৃহেই থাকতেন। সৌদামিনীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া তাঁর হয়নি। অন্তঃপুরে থাকলেও নিজ গুণে তাঁর মা সারদা দেবীর মৃত্যুর পরে তিনি সেই বৃহৎ পরিবারের কর্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে ‘গৃহরক্ষিতা’ বলতেন। অন্তঃপুরের নানা বিষয়ে সৌদামিনীর ওপর তিনি নির্ভর করতেন। পরিবারের সকলকে পরমদেবতার কাছে প্রতিদিন উপস্থিত করানোর মতো গুরুতর ভার তিনি সৌদামিনী দেবীকেই দিয়েছিলেন। সৌদামিনী ছিলেন সুগৃহিণী।মহর্ষির জন্য আসা আঙুরের বাক্সের তুলো জমিয়ে জমিয়ে তিনি লেপ তৈরি করেছিলেন।
পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল তাঁর। ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীর স্মৃতিতে আছে, 'শেষাশেষি আমরা তাঁকে বেশিরভাগ পিতৃ সেবারতই দেখেছি।' স্বামীর মৃত্যুর পর সৌদামিনী মহর্ষির সেবাতেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন। পরিবারের সবার প্রতি ভালবাসা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর স্মৃতিচারণে আছে, ’আমার বড় ননদ সৌদামিনী দেবী আমাদের খুব যত্ন করতেন।বাপের বাড়ীর জন্য তখন কাঁদতুম তখন সান্ত্বনা দিতেন, চুল বেঁধে দিতেন।' নবান্নের দিনে নবান্ন তৈরি করে ঘরে ঘরে পাঠাতেন তিনি। ভাইফোঁটায় তাঁর ঘরে ফোঁটা নিতে যেতেন সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ ভাইয়েরা।
বেশ ভালো লিখতেন সৌদামিনী। শুধু ‘পিতৃস্মৃতি' নয়, তাঁর লেখা ভ্রমণকাহিনিতে এক গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। কখনও পীরের আস্তানায় তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্মকে অনুভব করেছেন, কখনও রোমান ক্যাথলিকদের সঙ্গে হিন্দুদের উপাসনার মিল খুঁজে পেয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, 'রোমান ক্যাথলিকরা ঠিক আমাদের মতই মূর্ত্তি পূজা করে…..তবু আমরাই শুধু পৌত্তলিক।‘ সেকালের অন্তঃপুরচারিণীদের পক্ষে এই উচ্চারণ সহজ কথা নয়। সহজ ভাষায় বর্ণনাও সহজ নয়। নিয়মিত লেখার অভ্যাস ছিল না সৌদামিনীর। কিন্তু কী আশ্চর্য স্বচ্ছ ভাষায় তিনি লিখেছেন, 'সে স্থানটি এমন চমৎকার নির্জ্জন যে আমাদের ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিল না। যমুনা কুলকুলরবে বয়ে যাচ্ছেন, গাছের ডালে পাখীরা কলরব করছে-বড় মধুর।' সৌদামিনী দেবীর সব লেখায় সব কাজে এই মাধুর্যের ছোঁয়া মনকে স্নিগ্ধ করে। ‘প্রভু পূজিব তোমারে আজি বড় আছে আকিঞ্চন/হৃদয়-কপাট খুলি পেতেছি মন-আসন’- তাঁর রচিত এই গান যেমন মধুর তেমনই মধুর, তাঁর সম্পর্কে নাতি সৌমেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ, ’সন্ধেবেলায় নিয়মিত পায়চারি করতেন উত্তরের বারান্ডায়, কোনো কোনো দিন হঠাৎ তাঁকে দুই হাতে উঠিয়ে নিয়ে বারান্ডার এক কোণ থেকে আর এক কোণ পর্যন্ত দৌড়তুম।' ১৯২০ সাল, ১৮৪২ শকাব্দের ৩০ শ্রাবণে সৌদামিনী দেবীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হল।।