ঠাকুরবাড়ির 'গুজরাটি' বধূ: শ্রীমতী দেবী

‘জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শ্রীমতী কদাচিৎ আসত, শান্তিনিকেতন থেকে গানের কিম্বা অভিনয়ের দলের সঙ্গে' - সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই স্মৃতিচারণায় উল্লিখিত শ্রীমতী হলেন শ্রীমতী ঠাকুর।

যদিও তখন তিনি ছিলেন শ্রীমতী হাতি সিং। আমেদাবাদের এক প্রাচীন জৈন পরিবারে ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে তাঁর জন্ম হয়। পিতা শিল্পপতি পুরুষোত্তম হাতি সিং ও মা লীলা হাতি সিং।

মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন শ্রীমতী। সরকারি কলেজ ছেড়ে আমেদাবাদের ন্যাশনাল কলেজে পড়তে শুরু করেন। বিশ্বভারতী ও

শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। ১৯২২ সালে তিনি কলাভবনের ছাত্রী হন। নন্দলাল বসু ও অসিতকুমার হালদারের প্রত্যক্ষ ছাত্রী শ্রীমতী শান্তিনিকেতনে আসার আগে নৃত্যশিক্ষা করেছিলেন।

তাছাড়া গুজরাতের নিজস্ব গরবা নাচের ঐতিহ্য তো তাঁর ছিলই। এর সঙ্গে যুক্ত হল প্রথমে প্রতিমা দেবীর কাছে ভাবনৃত্য ও পরে সঙ্গীতভবনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা। পরবর্তী সময়ে তিনি দক্ষিণ ভারতীয় বিভিন্ন নৃত্যকলাও শিক্ষা করেছেন।

ভরতনাট্যম ও কথাকলির মতো শাস্ত্রীয় নৃত্যের পাশাপাশি লৌকিক নৃত্যেও তাঁর অধিকার ছিল বলে তিনি নৃত্য বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ভারতীয় নৃত্যধারার কোন বিশেষত্ব ‘The Dassiattam of South India - The Bharatnatyam as we call it today’তে আছে, কোন বৈশিষ্ট্য আছে ‘The Chakyar Koother of Malabar’-এর লোকনৃত্যে বা 'Kathakali belongs to this dramatic type’ - এমন মন্তব্য করার জন্য এই সব নৃত্যধারা বিষয়ে যে জ্ঞানের প্রয়োজন তা তাঁর ছিল।

সেরাইকেলার ছৌ থেকে উত্তর ভারতীয় কত্থক, দক্ষিণ কর্ণাটকের যক্ষাঙ্গনা, গুজরাতের ভাবাই - সবই ছিল তাঁর আয়ত্তে। ইউরোপিয় নৃত্য ধারা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। ‘In the European ballet, music is either an accompaniment or it follows the choreography.’ এভাবেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানান নৃত্যধারায় দীক্ষিত হয়ে এক নিজস্ব নৃত্য ভাবনা গড়ে তুলেছিলেন।


১৯২৭-২৮ সাল নাগাদ তিনি জার্মানি যান। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, 'বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে পেডাগজি (শিক্ষা বিজ্ঞান) পড়বার জন্য শ্রীমতী বার্লিনে এসেছিল’। জার্মানিতে শিশুশিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনার জন্য গেলেও তিনি সেখানে নাচ শিখেছেন।

ইয়োরোপের অন্যান্য দেশেও তিনি নাচ শিখেছেন, নাচ দেখেছেন তাছাড়া তাঁর নিজের তৈরি ভারতীয় নৃত্য পরিবেশনও করেছেন। সৌম্যেন্দ্রনাথের সহায়তায় জার্মানিতে নানান গুণীজনসঙ্গ করার মধ্যে দিয়ে তাঁর চেতনা আরও সমৃদ্ধ হয়েছিল। এই সময়কালে পোল্যান্ডে যুব সম্মেলনে শ্রীমতী ভারতীয় শিল্প বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছিলেন।

দেশে ফিরে আসার পর শ্রীমতী ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকের নৃত্য পরিবেশন করে গুণীজনদের মুগ্ধ করেছিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, "একবার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে 'ঝুলন’ - এই স্বরচিত কবিতাটি কবি নিজ কন্ঠে আবৃত্তি করলেন উচ্চৈঃস্বরে আর তার সঙ্গে সৌমেন্দ্রনাথের স্ত্রী শ্রীমতী দেবী নৃত্য পরিবেশন করলেন - সে এক অপূর্ব সমন্বয়।

গান নেই, বাজনা নেই - কিন্তু কবির কণ্ঠ আর নৃত্যের ভঙ্গিমা যে অনুভূতি দর্শকের মনে সেদিন জাগিয়েছিল - তার তুলনা মেলে না"। শ্রীমতী রবীন্দ্রনাথের 'শিশুতীর্থ’ নামের দীর্ঘ কবিতাটির সঙ্গে ও ভাবনৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শ্রীমতীর নাচ দেখে লিখেছিলেন, 'She takes delight in evolving new dance forms of her own in rythmic representation of ideas that offer scope to her spirit for revelling in its own ever-changing creations which according to me is the proper function of dance and a sure sign of her genius.’
১৯৩৭ সালে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।

১৯৪২ সালে তিনি অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে কারাবরণ করেন। এলগিন রোডে তাঁদের বাসভবনে তিনি একটি নৃত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শিল্পের সর্বক্ষেত্রে তাঁর প্রগাঢ় আগ্রহ এবং জ্ঞান ছিল। যদিও তাঁর যথার্থ টান ছিল নাচের প্রতি।

যে কারণে সমকালীন নাচে গতানুগতিকতার অনুরণন ও নিজস্ব চিন্তার অভাব তাঁকে যন্ত্রণা দিত। নৃত্যের নিজস্ব মর্যাদা নিয়ে তিনি বিশেষ ভাবিত ছিলেন। যেজন্য অনায়াসে তিনি বলেছেন, ‘It pains us to have to admit that our dance forms today have lost much of their dignity’.

বিশ্বচ্ছন্দ, লীলাবৈচিত্র্য, অভিসার কবিতা অবলম্বনে বাসবদত্তা ইত্যাদির মধ্যে শ্রীমতী ঠাকুরের অভিনব নৃত্যভাবনা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর শেষ উল্লেখযোগ্য নৃত্য পরিবেশনা ১৯৫০ সালে, নিউ এম্পায়ারে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবৃত্তির সঙ্গে তাঁর নিজস্ব ঘরানার নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন তিনি।

তাঁর গাওয়া ভজন শুনতে ভালবাসতেন মহাত্মা গান্ধী। সংগঠনের কাজেও তাঁর উৎসাহ ছিল। বৈতানিক এবং অবনীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসম্ভার তাঁর উদ্যোগে সংগৃহীত হয়েছিল। 'রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ' নামে একটি পত্রিকাও তিনি প্রকাশ করতেন। ১৯৭৮ সালের ১৭ জুলাই শ্রীমতী ঠাকুরের জীবনাবসান হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...