সংজ্ঞা দেবী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী সংজ্ঞা দেবী সমগ্র জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। তাঁর মা ইন্দিরা দেবী দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাই রাধানাথ ঠাকুরের পরিবারের শ্রীনাথ ঠাকুরের কন্যা। ইন্দিরা দেবী ছিলেন মহর্ষির স্নেহধন্যা। তাঁর বিবাহ হয়েছিল মহর্ষির অনুচর প্রিয়নাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে। স্বাভাবিক ভাবেই এই দম্পতির কন্যার সঙ্গে তাঁর পৌত্রের বিবাহ স্থির হওয়ায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ খুব আনন্দিত হয়েছিলেন।
স্বদেশী আন্দোলনের ঘোরতর সমর্থক সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদের আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। রূপে গুণে অতুলনীয় সুরেন্দ্রনাথ তাঁর ত্রিশ বছর পর্যন্ত বিবাহে আগ্রহী ছিলেন না। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিকথায় আছে, ’আমার তো একটিমাত্র ভাই বা দাদা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হন না অবশেষে মহর্ষির প্রিয় শিষ্য প্রিয়নাথ শাস্ত্রীর মেজো মেয়ে সংজ্ঞা সেজেগুজে তাঁর ভাইয়ের পৈতের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলে, আমার দেবর সুহৃ্ৎনাথের প্ররোচনায় তাঁর সঙ্গে সুরেনের বিয়ের কথাটা তোলা হয় এবং ক্রমে স্থির হয়’। ১৯০৩ সালে এই বিবাহ হয়। তখন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স একত্রিশ আর সংজ্ঞা দেবীর বারো। যদিও সেকালে এ কিছু আশ্চর্যের ছিল না।
অনিচ্ছার বিবাহ হলেও স্ত্রীর প্রতি সুরেন্দ্রনাথ যথেষ্ঠ অনুরক্ত ছিলেন। বিবাহের পর সংজ্ঞা দেবীকে যে 'পুণ্য’ পত্রিকার পাতায় অনুবাদিকা রূপে পাওয়া গেল তাতে সুরেন্দ্রনাথের যথেষ্ট উৎসাহ ও অবদান ছিল তা মনে করা যেতে পারে। ‘ইউরিশিমার মা’ ও ‘মৎসুয়ামার আয়না’ নামে দুটি গল্প সংজ্ঞা অনুবাদ করেছিলেন।
ভাষা ও ভঙ্গির সরসতায় দুটিই সুখপাঠ্য। সুরেন্দ্রনাথ তাঁর করা একগুচ্ছ জাপানি গল্পের বাংলা অনুবাদ 'একটি বসন্ত প্রাতের প্রস্ফুটিত সকুরা পুষ্প’ সংজ্ঞা দেবীকে উৎসর্গ করেছিলেন। অনুবাদের পাশাপাশি অভিনয়েও পারদর্শিতা ছিল সংজ্ঞার। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর 'বিসর্জন' নাট্যাভিনয় সম্পর্কে বলেছেন, 'রঘুপতির ভূমিকায় দিনেন্দ্রনাথের আর গুণবতীর ভূমিকায় আমার কাকী সংজ্ঞা দেবীর অভিনয় হয়েছিল অনবদ্য।‘ এই অভিনয় হয়েছিল এম্পায়ার থিয়েটারে, জোড়াসাঁকোর পারিবারিক পরিমণ্ডলে নয়।
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন, 'আমার মা ও ভাজ দুজনেরই দেবার খুব হাত ছিল। ধূমধাম করবার শখটাও ছিল; আর দুজনেরই স্বামী তাঁদের কোনো ইচ্ছায় বাধা দিতেন না। ‘ছ'টি সন্তানের জননী সংজ্ঞার ‘ধূমধাম করার শখ’ প্রথম জীবনে থাকলেও ধীরে ধীরে তাঁর মনের পরিবর্তন ঘটে। তাঁর পিতা প্রিয়নাথ শাস্ত্রী ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্ম ছিলেন। মা ইন্দিরাও ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল। সংজ্ঞা উত্তরাধিকার সূত্রে ভক্তি ও একনিষ্ঠতা লাভ করেছিলেন।
সাজতে ভাল লাগত না তাঁর। ধীরে ধীরে অন্য এক জগতের অধিকারী হয়ে উঠছিল তাঁর মন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী স্মৃতিকথায় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর বর্ণনায় লিখেছেন,'বউ বলে এই ঘটনা সে স্বপ্নে দেখেছিল’। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রয়াত হন। এই সময়ের আগে থেকেই আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি তীব্র আকর্ষণে সংজ্ঞা দেবীর জীবনধারায় পরিবর্তন আসছিল। সরলা দেবীর লেখায় আছে, "হায়! ৬ নম্বর জোড়াসাঁকোর বাঁধা অবিশ্বাসের পথ থেকে সরে অনেক ছেলেমেয়ে বউই যে যুক্তির অবলম্বনেই পুরনো বিশ্বাসের valley তে চলে এসেছেন, সে বিষয়ে ক্রমেই যত পরিচয় পেতে থাকলেন, ততই রবিমামা ক্ষুণ্ণ হতে থাকলেন"।
সংজ্ঞা দেবীর মানসিকতা পরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব জানা যায় না। তবে অন্য অনেকের পুরনো বিশ্বাসে ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সংজ্ঞার পার্থক্য আছে। সংসারে থেকেও তিনি নিয়মিত তীর্থ দর্শন, সাধুসঙ্গ করতেন। ছ'টি সন্তানের জননীর পরিচয়সীমায় তাঁকে বেঁধে রাখা যায় নি। তিনি সকলের জননী হতে চেয়েছিলেন। তাঁর কবিতাতেও সেই সুর বেজেছে 'সবারি যে মা হব গো হেথা/ সে রূপে হয়ে পূর্ণ বিকশিত।‘
এই আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা যে ঔপনিষদিক পথ থেকে ভিন্ন তা জেনেও বাধা দেননি সুরেন্দ্রনাথ। তিনি নিজেই সংজ্ঞা দেবীকে নিয়ে যেতেন নানান ধর্মীয পরিমণ্ডলে। নিয়ে গিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতার কাছে। আনন্দময়ী মা-র কাছেও গিয়েছিলেন সংজ্ঞা, ছিলেন ও তাঁর আশ্রমে। সুরেন্দ্রনাথের এই ঔদার্য বা ভালবাসার জন্যই হয়তো সংজ্ঞা দেবী তাঁর জীবদ্দশায় সংসার ত্যাগ করেননি। কিন্তু ১৯৪০-এর মে মাসে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পর তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বাধা সে ভাবে আসে নি। বাঞ্ছিতের সাক্ষাৎ তিনি পেয়েছিলেন কিনা তা জানা নেই।
তবে এলাহাবাদে সচ্চিদানন্দ সরস্বতীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুছে গেল অতীত পরিচয়, ঠাকুরবাড়ির বধূর হল নবজন্ম। সংজ্ঞা দেবী হলেন স্বরূপানন্দ সরস্বতী। এখানেই শেষ নয়। ফিরে এসেছিলেন তিনি...শান্তিনিকেতনে। ছোট একখানি বাড়িতে। থাকতেন সেখানেই। সন্ন্যাসিনীর গেরুয়া ত্যাগ করেননি আবার পারিবারিকতাও সম্পূর্ণ মুছে ফেলেননি। দু সুতোয় গাঁথা এক আশ্চর্য জীবন ।।