৫ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির 'পূর্ণিমা'

“কিন্তু মনের দিকে নজর পড়তে দেখি আমার স্মৃতির পট/ বাবার কথায় ভরা, কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই।/ সেখানে শুধু বাবা একা নয়; / বাবার সঙ্গে জড়িত সব কিছুরই সন্ধান পাওয়া গেল।/ এমন কি বাড়ির ঘরের কোণে আমাদের খেলার/ পুতুলগুলোতেও বাবার হাতের ছোঁয়া একটুও ম্লান হয়নি।“ – এমন লাবণ্যময় ভাষায় স্মৃতিকথা লিখেছেন পূর্ণিমা দেবী। জোড়াসাঁকোর ৫ নম্বর বাড়ির কন্যা। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমোদকুমারী দেবীর দ্বিতীয়া কন্যা পূর্ণিমার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা জোড়াসাঁকোতে।

৫ নম্বর বাড়ির অন্দরমহলের কথা খুব বেশি জানা যায় না। এই বাড়ির দৌহিত্রী প্রতিমা দেবী লিখেছেন, “গেছি সেই রূপকথার যুগে চলে যখন পাঁদারী পিসিমার লেপের তলায় এক ডজন ভাই বোন মিলে সেটিকে ভাগাভাগি করে নিয়ে যে যতটা পারে দখল করেছি পিসিমার কোলের কাজটা। তারপর চলল - গোলেবকাওলী, হাতেমতাই, কঙ্কাবতী – আমরা মর্ত্যলোক থেকে চলে যেতুম কে জানে কোথায়, কেবল পিসিমার গলার স্বর থাকত আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে”। এই সকলে মিলে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকা ছিল ৫ নম্বরের নিজস্বতা। গগনেন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত ওঁরা এভাবেই একসঙ্গে – অন্তরে ও বাহিরে, অন্দরে ও সদরে একসূত্রে বাঁধা ছিলেন।

সে বাড়ির মেয়েরা তখনো পর্যন্ত স্কুলে যেত না। পূর্ণিমা দেবী জানিয়েছেন, “ … ভোর চারটের সময় মঙ্গলারতি হত, …. বাগান থেকে ফুল কুড়িয়ে এনে মায়ের পুজোর জোগাড় করে দিয়ে বৌঠান পুজো করতে বসত। আমিও দুর্গানাম লিখতে বসতুম মায়ের কাছে। অগ্রহায়ণ মাসে ইতুপুজো করতুম।…. আমি দুর্গানাম লেখা সেরে আমার টাস্ক করতে বসতুম। পড়া শেষ হলে বাগানে খেলতে নেমে যেতুম”। প্রতিদিন বেলা এগারোটার মধ্যে ছেলেমেয়েদের খাওয়া হয়ে যেত। তারপর “ দিদি ও আমি বাবার কাছে গিয়ে গল্প শুনতুম। লন্ডন নিউজ আসত, বিলেতের খবর থাকত…..বাবা সব পড়ে শোনাতেন। একটা বাজলে বলতেন,' যাও এবার পড়োগে’”। একটার সময় আসতেন একজন মাস্টারমশাই।

বাড়িতে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে নাটক করা হত। একবার হয়েছিল 'আলিবাবা’। পূর্ণিমা দেবী তখন নিতান্তই ছোট-“আমরা গেরুয়া কাপড় পরে ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে নিয়ে গাইতে গাইতে আসি। আমার ন্যাড়া মাথা পরচুলো পরা।” যাওয়া হত চিড়িয়াখানায়, সার্কাসে অথবা কার্নিভ্যালেও।

এল আরও আনন্দের দিন - “ ……একদিন শুনি যে দিদির বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। শুনে খুব আনন্দ হয়েছিল। দিদির বয়স তখন ন বছর, আমার সাত বছর।…. আমার ফ্রক তৈরী হল।” তারপর “বাসি বিয়ের দিন দিদি চলে যেতে দিদির চেয়ে আমিই বেশী কান্নাকাটি করেছিলুম”। দিদি সুনন্দিনীর বিয়ের দিন সম্বন্ধ এসে গেল ছোট বোনেরও। “কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের মেয়েরা নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। আমায় দেখেই পছন্দ করেন”।

কিন্তু সম্বন্ধ যেচে এলেও “বারো বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেব না” বলে দিলেন দিদিমা অর্থাৎ সৌদামিনী দেবী। আসলে ন বছরে বিয়ে হওয়া সুনন্দিনী কিছুতেই শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইত না। তাঁর কান্নাকাটি দেখেই এই সিদ্ধান্ত। সেই কথা অনুসারে কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের মেয়ে সরোজিনী দেবী ও বিমলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোটছেলে নিশানাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে রইল পূর্ণিমা দেবীর।

বিয়ের আগে অনেক বার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন পূর্ণিমা। সেকালে এমন হত নাকি? অবশ্যই হত। জানিয়েছেন পূর্ণিমা নিজেই - “আমার শাশুড়ী একদিন বলে পাঠালেন, 'একদিন মেয়েকে এখানে আনব। বাবামশায় (কালীকৃষ্ণ ঠাকুর) দেখতে চান”। যেতে হবে শুনে কাঁদতে শুরু করল সেই সাত বছরের শিশু। “আমি ভাবলুম, দিদি যেমন শ্বশুরবাড়ি গেছে, আমাকেও বোধহয় সেইরকম করে ধরে রাখবে” ।

তারপর অনেক বোঝানোর পর পুরোনো এক দাসীকে নিয়ে যাওয়া হল সে বাড়ি। “ সেখানে খেয়েদেয়ে রাত্রে ফিরে এলুম অনেক খেলনা নিয়ে”। সেই থেকে মাঝেমধ্যেই যাওয়া হত ভাবী শ্বশুরবাড়ি। তবে,” বিয়ের একবছর আগে থেকে আর যেতুম না”। ১৩১৩ সনের অঘ্রাণ মাসে বিয়ে হল পূর্ণিমা দেবী আর নিশানাথ চট্টোপাধ্যায়ের। “ আমার বিয়ের সময় সবকিছুই দেশী জিনিস দেওয়া হবে ঠিক করা হয়। …. বাবা আগে থাকতে খোঁজ করে যেখানে যা দেশী জিনিস পাওয়া গেছে আনিয়েছেন”। বিয়ের পর থিয়েটারও হল বাড়িতে- ‘আলিবাবা’ আর ‘নসিব’- ‘অর্ধেন্দু মুস্তফী বিদ্যাদিগগজ সেজেছিলেন’। বিয়ের পরও গগনেন্দ্রনাথ তাঁকে একজিবিশন দেখিয়ে এনেছেন। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন পুরী বেড়াতেও।

একবার জোড়াসাঁকো এসে পূর্ণিমা দেবী দেখলেন ছোট কাকা অবনীন্দ্রনাথ খানিকটা মোম নিয়ে চটকে পুতুল তৈরি করছেন। দেখে শখ হল পূর্ণিমার - “ঐ রকম করে পুতুল তৈরী করে দেখাতে যাই। তাই দেখে বললেন, "বাঃ চমৎকার হয়েছে”। এরকম মোমের পুতুল অনেক বানিয়েছেন পূর্ণিমা। গগনেন্দ্রনাথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রোপর্শন কি রকম হবে।

বানাতে পারতেন খেলার বাড়ি-“ছোটকাকাকেও সিমেন্ট দিয়ে জালের ওপর জমিয়ে, একটা পাহাড় অঞ্চলের বাংলো তৈরী করে দিয়েছিলাম।… ছোট কাকা খুব খুশী হয়েছিলেন। “কাগজ দিয়েও বাড়ি বানাতেন পূর্ণিমা। একবার দানমেলায় পুরস্কারও পেয়েছিলেন কুরুশের সেলাইয়ের জন্য। সে নিয়ে অবশ্য অনেক জল ঘোলা হয়েছিল।

শিল্পী পিতার শিল্পী কন্যা পূর্ণিমা দেবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান স্মৃতিকথা । ঝরঝরে ভাষায় লেখা তথ্যপূর্ণ সেই স্মৃতিকথায় গগনেন্দ্রনাথ ও ৫ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির অন্দরমহলের নানা অজানা কথা বড় আন্তরিক ভাবে ফুটে উঠেছে। এই বাড়িতে যে জমিদারি থেকে তাঁতি এনে দেশি গেঞ্জির কল বসানো হয়েছিল বা লাটসাহেব কারমাইকেল যে জোড়াসাঁকোয় এসে গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে গদিতে বসে গল্প করতেন, কড়াইশুঁটি দিয়ে চিঁড়েভাজা খেতে ভালো বাসতেন এতটাই যে ‘এখান থেকে চিঁড়েভাজা কৌটায় করে বিলেত নিয়ে গিয়েছিলেন’, টাকা না নিয়ে এই বাড়ির গুণীজনদের নাচ দেখিয়েছেন উদয়শঙ্কর অথবা দুঃস্থ আত্মীয়দের সাহায্য করার জন্য রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ প্রমুখেরা মিলে 'পারিবারিক হিতকারী সভা’ গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই সভার ফান্ড বৃদ্ধির জন্য ' দানমেলা’ তৈরী করেছিলেন সেসব কথা জানিয়েছেন পূর্ণিমা দেবীই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে পূর্ণিমা দেবী কৃষ্ণনগর চলে যান। সেখানেই ১৯৪২-এর আশেপাশে অসুস্থতার কারণে তাঁর স্বামী নিশানাথের মৃত্যু হয়। তার বহু পরে অতি বৃদ্ধ বয়েসে পূর্ণিমা দেবী লিখেছিলেন তাঁর স্মৃতিকথা। ১৯৯২সালে প্রয়াত হন পূর্ণিমা দেবী।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...