ঠাকুরবাড়ির 'প্রতিমা'

‘এ বাড়ি আর ও বাড়ির জীবনযাত্রা তখন দুই পথে বইছে। মহর্ষিদেবের বাড়িতে চলছে তখন নতুন সৃষ্টির কাজ, সনাতনী প্রথা ও প্রাচীন সংস্কারকে পরিমার্জন করে তৈরী হচ্ছে সভ্যতার নতুন রূপ।‘ - এই স্মৃতিচারণা যাঁর তিনি প্রতিমা দেবী। পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথদের বোন বিনয়নী দেবীর কন্যা।

তাঁর পিতার নাম শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়। জোড়াসাঁকো বাড়ির অধিকাংশ জামাতার মতো শেষেন্দ্রভূষণ ও জোড়াসাঁকোয় থাকতেন। সেই কারণে প্রতিমা দেবীর শৈশব-কৈশোর পাঁচ নম্বর বাড়ির অসামান্য নান্দনিক পরিমণ্ডলে অতিবাহিত হয়েছে।

১৮৯৩ সালের ৫ নভেম্বর জন্ম প্রতিমা দেবীর। টুকটুকে সুন্দরী শিশু প্রতিমাকে খুব পছন্দ ছিল রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর। তিনি বলেছিলেন, 'এই সুন্দর মেয়েটি কে আমি পুত্রবধূ করব। আশা করি ছোটদিদি তাঁর নাতনীটি আমায় দেবেন।‘ নিতান্ত অসময়ে ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু হলে তাঁর ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে যায়।

মাত্র ১১ বছর বয়েসে প্রতিভার বিবাহ হয় গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট বোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পূর্ণিমা দেবী লিখেছেন, 'আমার ঠিক মনে নেই, বোধহয় বাংলা ১৩১০ সালের ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি প্রতিমা দিদির ফুলশয্যার নিমন্ত্রণ ছিল। …..আমি গিয়েছিলুম। বেনেপুকুরে ওঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল। ‘ফাল্গুন মাসে বিয়ের পর প্রতিমা

জোড়াসাঁকোতেই ছিলেন। বৈশাখ মাসে 'ভালো দিন’ দেখে প্রতিমাকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া হল। সেখান থেকে সকলে মিলে গঙ্গার ধারে মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাগানবাড়ি 'সুরধুনী কাননে' বেড়াতে গেলেন। কয়েক দিন সেখানে থাকার পর একদিন কারোর বারণ না শুনে নীলানাথ একটা চাকরকে নিয়ে নদীতে সাঁতার শিখতে গেলেন। হঠাৎ আসা বানে নীলানাথ ডুবে যান।

এই ঘটনাটি প্রতিমা দেবী আর তাঁর এক সঙ্গিনী ছাদ থেকে দেখেছিলেন। অপয়া অপবাদ নিয়ে জোড়াসাঁকোতেই ফিরে এলেন প্রতিমা। বৈধব্যজীবন যাপন করলেন পাঁচটি বছর। মৃণালিনী দেবীর ইচ্ছে অজানা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। রথীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরে আসার পর রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেছিলেন, 'তোমার উচিত প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়া।বিনয়িনীকে বল যেন অমত না করে।

ওর জীবনে কিছুই হল না। এ বয়সে চারিদিকের প্রলোভন কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। এখন না হয় মা-বাবার কাছে আছে, এর পরে ভাইদের সংসারে কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকবে। সেইটাই কি তোমাদের কাম্য? না বিয়ে দেওয়া ভালো, সেটা বুঝে দেখ। ‘গগনেন্দ্রনাথ রাজি করিয়েছিলেন বিনয়িনী দেবী এবং প্রতিমা দেবীকে। বলেছিলেন, 'যা তোর হয়ে গেছে সেটা স্বপ্ন ভেবে নিস।এখন নতুন জীবন আরম্ভ করতে হবে'। ১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রতিমা দেবী আর রথীন্দ্রনাথের বিবাহ হল। মৃণালিনী দেবীর ইচ্ছে পূর্ণ হল।

বিয়ের পর প্রতিমা দেবীকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত রথীন্দ্রনাথ ভগ্নিপতি নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, 'প্রতিমা এখন আমার…..সে যে কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী করে লিখি।‘ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে এই প্রথম বিধবাবিবাহ। বিয়ের পর নবদম্পতি শান্তিনিকেতনে ছিলেন কয়েকমাস।

সে সব দিনের কথা স্মরণ করে প্রতিমা দেবী বলেছিলেন, "আমার শিক্ষা-দীক্ষা যা কিছু সব আমার স্বামী এবং শ্বশুরের কৃতিত্ব। ….যখন প্রথম এখানে এলাম বাবামশাই শিশু বিভাগের কুড়ি-পঁচিশটি ছোটো ছোটো ছেলে ও আশ্রমের অন্যান্য সকলকে দেখিয়ে বললেন, 'বৌমা এই সব নিয়েই তোমার সংসার'। শৈশব থেকেই আমিও তাই বুঝেছি"।

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন গভীর স্নেহে।পতিসর থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন - “আমার সংসারকে তুমি তোমার পবিত্র জীবনের দ্বারা দেবমন্দির করে তুলবে এই আশা প্রতিদিনই আমার মনে প্রবল হয়ে উঠচে"। এর কিছু পরে রথীন্দ্রনাথ- প্রতিমা গেলেন শিলাইদহে।

সেখানে মিস বুর্ডেটের কাছে সেলাই শেখার পাশাপাশি ইংরেজিতে কথাবার্তা শুরু করতে বললেন রবীন্দ্রনাথ। জানতে চাইলেন রথীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সেই অ্যাস্ট্রোনমির বই পড়ে’ শোনাচ্ছেন কী না। এত আয়োজন সত্ত্বেও রথীন্দ্রনাথ – প্রতিমা দেবী সম্পর্কে এল ভাটা। জীবনের শেষ পর্যন্ত যাতে আর কখনও জোয়ার লাগল না।

প্রতিমা দেবী নিজে খুব ভাল ছবি আঁকতেন। গগনেন্দ্র-অবনীন্দ্র-সুনয়নীর উত্তরাধিকার তিনি বহন করেছিলেন। ইতালীয় শিল্পী গিলহার্ডির কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলেন তিনি। জাপানি শিল্পী কাম্পো আরাই-র কাছে জাপানি পদ্ধতিতে ছবি আঁকার তালিম নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। লন্ডনে থাকার সময় সেরামিক পেন্টিং, জাভার বাটিক ও ফ্রেস্কোর কাজ শিখেছিলেন। শিখেছেন ফরাসি শিল্পী আঁন্দ্রে কাপ্লের কাছে ও। তাঁর পেন্সিলে আঁকা গান্ধীজির প্রতিকৃতির
কথা জানিয়েছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ও রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার নানা দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। সেই সব দেশের পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপের মধ্যে দিয়ে প্রতিমা দেবী নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

প্রতিমা দেবীর লেখার হাত ছিল মধুর। কবিতা, গল্প,স্মৃতিকথা যা যা লিখেছেন সবই অত্যন্ত সাবলীল ও সরস। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছদ্মনাম রেখেছিলেন কল্পিতা দেবী। দখল ছিল তাঁর চিত্র সমালোচনাতেও। রবীন্দ্রনাথের 'শেষ বয়সের প্রিয়া’ অর্থাৎ তাঁর আঁকা ছবি বিষয়ে প্রতিমা দেবীর বিশ্লেষণ যেমন তথ্যসমৃদ্ধ তেমনই রসোত্তীর্ণ।

প্রতিমা দেবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি রবীন্দ্রনৃত্যের রূপকার। মঞ্চে অভিনয় তিনি বিশেষ করেননি কিন্তু তাঁরই আগ্রহে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব নৃত্যধারা গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় মূলত বাংলাদেশে মেয়েদের নাচের প্রচলন হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাম এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিকথায় আছে কীভাবে কালমৃগয়ায় তিনি ও ঊষা দেবী বন দেবী সেজে দুই আঙুল ওপর দিকে তুলে 'দুটি তারা আকাশে ফুটিয়া’ দেখাতেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভায়’ লক্ষ্মীর ভূমিকায় যখন তিনি বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখাতেন তখন‌ তাঁর খুড়তুতো বোন অভিজ্ঞা বলতেন ‘মনে হয় যেন পেট কামড়াচ্ছে’। বহুদিন পর্যন্ত এ ভাবেই চলেছে।

প্রতিমা দেবীও প্রথম দিকে ভাবনৃত্যই শেখাতেন। ‘বর্ষামঙ্গলের’ দু একটা নাচে সামান্য নৃত্যভঙ্গী প্রয়োগ করার পর প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথকে 'পূজারিণী' কবিতার নৃত্যরূপ করে দিতে অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্ত্ত ১৯২০ সাল নাগাদ শান্তিনিকেতনে নাচ শেখানোর জন্য বুদ্ধিমন্ত সিং-কে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর এসেছিলেন নবকুমার সিংহ। ১৯২৩/২৪ সাল নাগাদ

শান্তিনিকেতনে যে নাচের আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাতে প্রতিমা দেবীর অবদান কতখানি তা জানা যায় কালিদাস নাগের লেখা থেকে - “শ্রদ্ধেয়া প্রতিমা দেবী প্রথম থেকেই তাদের উৎসাহ দিয়েছেন এবং নটরাজ রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা নির্দেশাদি বুঝে প্রতিমা দেবীই প্রধানত 'শান্তিনিকেতন রীতি’র নৃত্যাভিনয়ের পাকা বনিয়াদ ও রঙ্গমঞ্চ গড়ে গেলেন, একথা হয়ত অনেকে জানেন না’। নটীর পূজা, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, মায়ার খেলার নবরূপ ইত্যাদিতে নেপথ্যে ছিলেন প্রতিমা।

গানের স্বরলিপির মতো শান্তিনিকেতনের এই নিজস্ব নৃত্যরীতি ধরে রাখবার জন্য কলাভবনের শিল্পী দের দিয়ে নৃত্যের ভঙ্গী আঁকিয়ে রাখার চেষ্টাও করেছেন তিনি। নৃত্য বিষয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা ধরা আছে ‘নৃত্য’ নামের বইটিতে।রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে দৃশ্যসজ্জা, রূপসজ্জার যে শীলিত সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে তাতে প্রতিমা দেবীর অনেকখানি অবদান।

শান্তিনিকেতন আশ্রম ও তার চারপাশের অঞ্চলের উন্নতি সাধনের জন্য প্রতিমা দেবীর উৎসাহে আলাপিনী মহিলা সমিতির জন্ম। শুরুতে আশেপাশের গ্রামের মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কাজ ছিল আলাপিনীর প্রধান উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথ এই সমিতির নামকরণ করেছিলেন। এই সমিতির সঙ্গে প্রতিমা দেবীর ছিল প্রাণের যোগ।

তাঁর লেখা অতুলনীয় স্মৃতিকথাগুলিতে চেনা পরিবারের অজানা ছবি ফুটে উঠেছে। ‘মনে পড়ে মেঝেতে মাদুর পেতে বসে গেছেন জাপানী আর্টিস্টের দল। আর একদিকে গগনেন্দ্র অবনীন্দ্র চালাচ্ছেন তাঁদের তুলি'। জানা যায় 'সন্ধ্যা’ ও 'যুগান্তর’ পত্রিকা তখন জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়িতে হাতে হাতে ঘুরত। এমনকি, 'দিদিমাও দেখতুম এ রসে বঞ্চিত ছিলেন না’। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দিনগুলির মর্মস্পর্শী বর্ণনা আছে ‘নির্বাণ' বইটিতে।

রূপে গুণে অতুলনীয়া তাঁর বৌমা - 'bride-mother'-এর প্রতিভার ওপর রবীন্দ্রনাথের কতখানি আস্থা ছিল তার প্রমাণ - 'গান,নাচ এবং যন্ত্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম তোমাকেই তৈরি করতে হবে’ অথবা 'তোমার অনুপস্থিতিতেই চণ্ডালিকার অনেক কাটাছাঁটা
টা করতে হয়েছে - তোমার মঞ্জুরির অপেক্ষায় রইলুম’ কিংবা চণ্ডালিকার অভিনয় প্রসঙ্গে লেখা, 'বাহুল্য নাচ গান বর্জন করা দরকার বোধ হল।...এ সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে আলাপ করব', ইত্যাদি চিঠি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের কাজেই নিজেকে মগ্ন রেখে ছিলেন। শান্তিনিকেতনেই থাকতেন তিনি। প্রচারবিমুখ এই বিদুষী ১৯৬৯র ৯ জানুয়ারি প্রয়াত হন।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...