রূপে-গুণে অতুলনীয়া কন্যাটিকে হেমেন্দ্রনাথ ভর্তি করেছিলেন লরেটো হাউসে

হারিয়ে যাওয়া প্রতিভা
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথমা কন্যা প্রতিভাসুন্দরী দেবীর জন্ম ১৮৬৫ সালে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে।রূপে-গুণে অতুলনীয়া কন্যাটিকে হেমেন্দ্রনাথ ভর্তি করেছিলেন লরেটো হাউসে। পাশাপাশি চলেছিল গানবাজনায় নিবিড় তালিম।মা নীপময়ী দেবীর মতো প্রতিভার ও গানের গুরু বিষ্ণু চক্রবর্তী। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে তিনি শিখেছিলেন বিলিতি গান। তালিম ছিল সেতার ও পিয়ানোয়। মাঘোৎসবে প্রকাশ্য জনসভায় ভাইদের সঙ্গে গান গেয়েছিলেন প্রতিভা – যা তখনকার দিনে ছিল অভাবনীয়।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ সঙ্গীত বিষয়ে অত্যন্ত সূক্ষরুচিসম্পন্ন ছিলেন। সৌদামিনী দেবীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘প্রতিভার পিয়ানো এবং রবির গান শুনিতে তিনি ভালোবাসিতেন। ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভায় তাঁর গান আর সেতার বাজানো শুনে সঙ্গীতরসিক রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর তাঁকে স্বরলিপির বই উপহার দিয়েছিলেন। রঘুনন্দন ঠাকুর দিয়েছিলেন তানপুরা।
শুধু গানবাজনা নয়, প্রতিভা দেবীর দখল ছিল অভিনয়েও। 'বাল্মীকি প্রতিভা'য় সরস্বতীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পারিবারিক গণ্ডীর মধ্যে অনেক মহিলাই অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু প্রতিভার আগে ভদ্র পরিবারের কন্যারা কেউ মঞ্চে অবতীর্ণ হন নি। তাঁর অভিনয় দক্ষতায় মোহিত রবীন্দ্রনাথ 'বাল্মীকি প্রতিভা' গীতিনাট্যে তাঁর নাম যুক্ত করেছিলেন। বাংলা

১২৮৭ সনের ১৬ ফাল্গুন তারিখে বিদ্বজ্জনসভায় ‘বাল্মীকি প্রতিভার' অভিনয়ে প্রতিভার সরস্বতীর ভূমিকা চমক লাগালো সাংবাদিকদের। আর্যদর্শন কাগজ লিখেছিল, ’শ্রীযুক্ত বাবু হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা নাম্নী কন্যা প্রথমে বালিকা পরে সরস্বতী মূর্তিতে অপূর্ব অভিনয় করিয়াছিলেন।‘

হেমেন্দ্রনাথ প্রতিভাকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, '…যদি বেঠোফেন প্রভৃতি বড় বড় জার্মান পণ্ডিতদের রচিত গানবাজনা শিক্ষা করিতে পার এবং সেই সঙ্গে মিউজিক থিওরি শেখ তবেই আসল কর্ম হয়। ‘পিতার এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেছিলেন প্রতিভা। একই সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন ও সঙ্গীততত্ত্ব দুয়েতেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। অবনীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় আছে,’আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি বাবামশায়ের আমলে বাড়িতে তখন বিদ্বজ্জনসমাগম বলে একটা সভা বসত।…প্রতিভাদিদির ওস্তাদী গান হত।‘

প্রতিভার বিবাহ হয়েছিল প্রমথ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে। বিলেত যাবার সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, শেষে আত্মীয়তা। বিয়ের পরও প্রতিভা গানের চর্চা বজায় রেখেছিলেন। শুধু গান গাওয়া বা অভিনয় করা নয়, প্রতিভার বৈশিষ্ট্য স্বরলিপি নির্মাণে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে স্বরলিপির গুরুত্ব সকলেরই জানা। স্বরলিপি দেখে গান গাইতে অনেকেই পারেন কিন্তু স্বরলিপি তৈরি করা সহজ নয়।

প্রতিভা দেবীর আগে কোনো বাঙালি মহিলা স্বরলিপি নির্মাণ করেছেন বলে জানা যায় না। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বরলিপি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁদের স্বরলিপি পদ্ধতিকে সহজবোধ্য করেছিলেন প্রতিভা। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ ও কালমৃগয়ার প্রথম স্বরলিপি প্রতিভার করা। ‘বালক’ পত্রিকায় তাঁর করা বহু স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে। একাধিক ব্রহ্মসঙ্গীতের স্বরলিপির পাশাপাশি বেশ কিছু হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের স্বরলিপিও প্রতিভা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সুর দেওয়া অনেকগুলি বেদগানের স্বরলিপি যেমন তিনি করেছিলেন, তেমনই কিছু বেদগানে তিনি সুর ও দিয়েছেন। তাঁর নিজের লেখা গানের কয়েকটি হল – ‘সাঝের প্রদীপ দিনু জ্বালায়ে’, ’দীনদয়াল প্রভু ভুলো না অনাথে’ ইত্যাদি।

সারাজীবনে প্রতিভা সঙ্গীতের প্রায় সব কটি দিকের চর্চা করে গিয়েছেন। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন ‘আনন্দ সঙ্গীত পত্রিকা’। এক আধ বছর নয় পত্রিকাটি চলেছিল আট বছর। এই পত্রিকায় প্রতিভা স্বরলিপি প্রকাশের পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীত ও সঙ্গীতসাধকদের জীবনীও প্রকাশ করতেন।

প্রতিভা দেবীর গান, সেতার অথবা পিয়ানো বাদন কোনোটাই শোনার কোনো উপায় নেই আর। কালস্রোতে সব ভেসে গিয়েছে। ১৯২২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'সঙ্গীত যে শুধু তাঁর কণ্ঠে আশ্রয় নিয়েছিল তা নয়, এ তাঁর প্রাণকে পরিপূর্ণ করেছিল।‘ তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে এক আশ্চর্য সঙ্গীতসাধিকা।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...