জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক ব্যতিক্রমী বধূ প্রফুল্লময়ী দেবী। দুঃখের সুকঠিন আঘাতকে আত্মস্থ করে অন্তঃপুরের অন্তরালে সুদীর্ঘ জীবন যাপন করে গিয়েছেন। হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়ার হরদেব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। তাঁর এক কন্যা নীপময়ী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আর এক কন্যা প্রফুল্লময়ী দেবীর জন্ম কলকাতায়, সিপাহী বিদ্রোহের কাছাকাছি সময়ে।
নীপময়ী দেবীর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বিবাহ সূত্রে তাঁর মা ও বোন প্রফুল্লময়ী মাঝেমাঝে জোড়াসাঁকোয় আসতেন। সেখানে স্বর্ণকুমারী দেবী ও শরৎকুমারী দেবীর প্রফুল্লময়ী দেবীকে দেখে পছন্দ হয় ও মহর্ষির চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহ স্থির করেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, 'মুখের গড়ন ও রঙ ছিল অত্যন্ত সুন্দর।
অত বয়সেও মনে হত স্বর্ণচাঁপার পাঁপড়ির ফিকে সোনা রঙ কেউ যেন মাখিয়ে দিয়েছে তাঁর গায়ে।‘ সৌমেন্দ্রনাথ যখনকার কথা বলেছেন তখন প্রফুল্লময়ী সর্বতোভাবে নিঃস্ব, রিক্ত। অর্থকষ্টে জর্জরিত বৃদ্ধা। তখনই যদি এত রূপ থাকে তবে বালিকা বেলায় তিনি যে অত্যন্ত আকর্ষণীয়া ছিলেন তা অনুমান করা যায়। নীপময়ী দেবীর বিবাহের দু বছর পরে ফাল্গুন মাসের ৮ তারিখে বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহ হল প্রফুল্লময়ী দেবীর। তখন তাঁর বয়স ছিল বারো বছর ছ মাস, সাল ১৮৬৪। আশ্বিনের ঝড়ের বছর।
প্রফুল্লময়ী দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, বীরেন্দ্রনাথ চার ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন । বিয়ের পরদিন তাঁদের আনতে গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাড়ির সরকার আর গয়নার বাক্স নিয়ে।‘আমাকে সেই সকল গহনা কাপড় পরাইয়া, মা আমার দুর্গা প্রতিমার স্তব করিয়া আমাকে পাল্কীতে তুলিয়া দিয়া পা মুছাইয়া দিলেন।‘ বালিকা মা-বাপের জন্য চোখের জল ফেলতে শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করল।
তখন কি আর জানা ছিল, এই যে শুরু হল চোখের জল ফেলা তার আর শেষ হবে না কখনও! শ্বশুরবাড়িতে তিনি সাদরে গৃহীত হয়েছিলেন। শাশুড়ি, বড় ননদ সৌদামিনী দেবী, এমনকি বড় জা সর্বসুন্দরী দেবীর স্নেহও পেয়েছিলেন প্রফুল্লময়ী। লজ্জাবতী বালিকা একহাত ঘোমটা টেনে কোনোরকমে খেতেন। ঘোমটা বিরোধী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রফুল্ল ময়ী খেতে বসলে পর্দার আড়াল থেকে উঁকি মেরে কীভাবে তিনি খান তা দেখার চেষ্টা করতেন। এমনকি নানারকম ঠাট্টাও করতেন।
বিকেলবেলা মালিনীদের আনা ফুলের মালা দিয়ে সেজে, দেওর-ননদ-জায়েদের সঙ্গে আনন্দে দিনযাপন অল্পদিনের মধ্যেই স্মৃতিমাত্র হয়ে উঠল প্রফুল্লময়ীর কাছে। বিয়ের পর বীরেন্দ্রনাথ এন্ট্রান্স পাশও করেন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর মস্তিষ্কের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করল। কোনো চিকিৎসাতেই রোগ না কমায় তাঁকে আলিপুরের পাগলা গারদে কিছু দিন রাখা হল। সেখান থেকে কিছুটা ভালো হয়ে বাড়ি এলেন বীরেন্দ্রনাথ। বাংলা ১২৭৭ সনে তাঁদের একমাত্র সন্তান বলেন্দ্রনাথের জন্ম হল।
শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল হলেও বলেন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চা করতেন তিনি। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। ছাব্বিশ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হল সাহানা দেবীর সঙ্গে। এতদিনে সুখের মুখ দেখলেন প্রফুল্লময়ী। কিন্তু সেই আনন্দও বেশী দিন স্থায়ী হল না।
নিতান্ত অল্পবয়সে প্রয়াত হলেন বলেন্দ্রনাথ-‘অনেকক্ষণ তাকে লইয়া বসিয়া রহিলাম। তারপর সকলে আমাকে অন্যঘরে লইয়া গেল।‘ এই মর্মান্তিক ব্যথাও বুকে চেপে রেখেছিলেন প্রফুল্লময়ী। উন্মাদ স্বামী, কিশোরী পুত্রবধূ – কার কাছে নিজের দুঃখ প্রকাশ করবেন তিনি? ‘বুকের মধ্যে সবই তখন শূন্য হইয়া গিয়াছে।
শূন্যতার কঠিন মর্ম তারাই বুঝিতে সক্ষম হইবে, যাহারা এই পুত্রশোকের তীব্র জ্বালা অনুভব করিয়াছে।……তাহার মৃত্যুর পর সেই ঘরেই দরজা বন্ধ করিয়া অচেতন অবস্থায় পড়িয়া থাকিতাম।…..তাঁহারই ঘরের সামনের বারান্দায় একটি মাদুরের উপর দিনরাত্রি শুইয়া কাটাইতাম। জল ঝড় বৃষ্টি সবই আমার উপর দিয়া যাইত কিন্তু আমার তখন কোন দিকেই হুঁশ ছিলনা।‘
শোকের প্রাবল্যে আত্মহারা অবস্থায় প্রফুল্লময়ী এক উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হলেন, 'মনে হইল, যিনি তাহাকে দয়া করিয়া আমার কোলে আনিয়া দিয়াছিলেন তিনিই তাঁহার সমস্ত অভাব মোচন করিয়া দিবেন।‘ এই সময় থেকে নানান ধর্মপুস্তক পাঠ ও শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতদের সদুপদেশের মধ্যে দিয়ে আপাত শান্তির যে আবহ তিনি গড়ে তুলেছিলেন পুত্রবধূ সাহানার মৃত্যুতে তাও ছিন্ন হয়ে গেল।
জীবন তাঁকে কী দিয়েছিল? উন্মাদ স্বামী, অকালপ্রয়াত পুত্র, পুত্রবধূ, অর্থাভাব তা সত্ত্বেও জীবনের প্রান্তসীমায় এসে নিজের কথা লিখতে বসে শাশুড়ি, বড় জা, বড় ননদের মমতা ও ভালোবাসার কথা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন তিনি। সুগায়িকা ছিলেন তিনি। তাঁর গান শুনে খুশি হয়ে গান শেখার বন্দোবস্তও করে দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
তবে সেসব ছিল সুখের দিনের কথা।যদিও অনেক আঘাতেও সেইসব গান তিনি ভুলে যাননি। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিতে উজ্জ্বল সেকথা, ’গাইতেও পারতেন চমৎকার।…তাঁদের সময় বাড়িতে ছিলেন প্রসিদ্ধ গায়ক বিষ্ণু। তাঁর কাছ থেকে যেসব গান শুনে শিখেছিলেন, তা প্রায়ই গাইতেন।‘
এত যে ভাল গাইতেন অথচ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অথবা শান্তিনিকেতনে কোথাও তাঁকে দেখা যায়নি। কেউ ভাবেনি তাঁর কথা, কেউ দেখেনি তাঁকে। জীবনের এত না পাওয়া তাঁকে রুক্ষ, শুষ্ক করে তোলে নি। ‘ন দিদি তাঁর সমস্ত আদর ঢেলে দিলেন আমার উপর।...রোজ সকালে তখন পান সাজতে বসতেন তখন আমি গিয়ে জুটতুম।…….শুনতুম তাঁর কাছে সেকালের গল্প।‘ সে গল্পে কোথাও নিজের যন্ত্রণা, অবহেলা, না পাওয়ার কথা আসেনি কখনও।
এখানেই তিনি অনন্য। গুণ তাঁর যত ছিল, বিকাশ তার কিছুই হয়নি। বঞ্চিত হয়েছিলেন সম্পত্তি থেকেও। তবু গান গেয়েছেন, তবু ভালবেসেছেন পৌত্রকে। তবু স্মৃতিকথা লিখতে বসে দুঃখের দিনে কিভাবে অন্তরতর চিরসখার সান্নিধ্য অনুভব করেছেন সেই উপলব্ধির কথাই তুলে ধরেছেন। ১৯৪০ সালে সৌম্যেন্দ্রনাথ যখন জেলে তখন মৃত্যু হয় প্রফুল্লময়ী দেবীর - ‘তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মহর্ষির আমলের শেষ সুরের রেশটুকু মিলিয়ে গেল জোড়াসাঁকো বাড়ি থেকে’ - বলেছেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।।