"আমার বয়স যখন দশ বৎসর, সেই সময় আমার দিদি নৃপময়ী দেবীর সহিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়" - স্মৃতিকথায় এমনই বলেছেন মহর্ষির চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী প্রফুল্লময়ী দেবী। হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া গ্রামের হরদেব চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “ইনি ইংরেজি শিক্ষা একেবারেই পান নাই। সেকেলে রীতি অনুযায়ী একটু বাঙ্গলা ও একটু ফার্শি জানিতেন মাত্র। কিন্তু প্রাচীনতন্ত্রের লোক হইলেও ইনি খুব সৎসাহসী ও সমাজসংস্কারের অত্যন্ত পক্ষপাতী ছিলেন”। তাঁর দুই কন্যা নীপময়ী (প্রফুল্লময়ী যদিও নৃপময়ী লিখেছেন) ও প্রফুল্লময়ীর সঙ্গে মহর্ষির দুই পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ও বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবাহ হয়।
নীপময়ীর বিবাহের সময় কন্যাপক্ষের জ্ঞাতিকুটুম্বেরা বেশ সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। ঠাকুর পরিবার একদিকে পিরালি আবার অন্য দিকে ব্রাহ্ম। স্বাভাবিকভাবেই তারা মনে করলেন, “এই বিবাহ হইলে তাহাদের জাত নষ্ট হইবে”, সেই আক্রোশে বরকে হত্যা করার জন্য একশো লাঠিয়াল ঠিক করা হয়েছিল।
বাধ্য হয়ে কন্যাপক্ষ পুলিশের সাহায্য নিয়েছিল যদিও শেষ অবধি কোনো সমস্যা হয়নি। বরবেশী হেমেন্দ্রনাথের বর্ণনা শোনা যাক প্রফুল্লময়ীর জবানীতে, “বর যখন বিবাহের আসরে আসিয়া বসিলেন তখন মনে হইতেছিল সত্য সত্যই যেন মহাদেব ধরাতলে অবতীর্ণ হইয়াছেন। তেমন রূপ, আবার তেমনি সাজের বাহার।….সে যে তাঁহাকে কী সুন্দর দেখাইয়াছিল তাহা আজও ভুলিতে পারি নাই”। দিনটি ছিল ১৮৬৩ সালের ২৬ নভেম্বর ।
হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন মহর্ষির সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া ও সাহসী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলেন। সে পড়া অর্ধসমাপ্ত হলেও, বিজ্ঞানচর্চায় তাঁর আগ্রহ ছিল আন্তরিক। আগ্রহ ছিল শরীরচর্চাতেও। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী জানিয়েছেন, “সেজঠাকুরপোই বেশি কুস্তি করতেন।
বোধহয় ছেড়ে দেবার পর যে বাতে ধরল তাতেই অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে মারা গেলেন”। অন্তঃপুরে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী লিখেছেন, “বিয়ের পর আমার সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছে করে আমাদের পড়াতেন। তাঁর শেখাবার দিকে খুব ঝোঁক ছিল”। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন, “এই সময়ে আমার সেজদাদাও (হেমেন্দ্রনাথ) মেয়েদিগকে 'মেঘনাদবধ’ প্রভৃতি কাব্য পড়াইতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছিলেন”।
অন্তঃপুরচারিণীদের পাশাপাশি বাড়ির ছোটদের শিক্ষার দিকেও তাঁর নজর ছিল। ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা চর্চাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “যখন চারিদিকে খুব করিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধূম পড়িয়া গিয়াছে, তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘ কাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গত সেজদাদার উদ্দেশ্যে সকৃতজ্ঞ প্রণাম নিবেদন করিতেছি”।
হেমেন্দ্রনাথ সঙ্গীতচর্চাতেও উৎসাহী ছিলেন। এই ক্ষেত্রে তিনি জোড়াসাঁকো বাড়িতেও ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর আগে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কেউ স্ত্রীকে গান শেখাবার জন্য সচেষ্ট হননি। যদিও অন্তঃপুরের অনেকেই গান গাইতে পারতেন। হেমেন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী নীপময়ীকে গান শেখাবার জন্য জোড়াসাঁকো বাড়ির গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তীকে নিয়োগ করেছিলেন।
এ জন্য অবশ্য তাঁকে মহর্ষির অনুমতি নিতে হয়েছিল। গানের পাশাপাশি হেমেন্দ্রনাথ নীপময়ীকে তবলা ও করতাল বাজাতেও শিখিয়েছিলেন। ইংরেজি ভাষাতে যথেষ্ট দখল ছিল নীপময়ীর। শিখেছিলেন সংস্কৃতও। দেশি রান্না ছাড়াও নানা ধরনের বিদেশি রান্নাও তিনি জানতেন। তবে তাঁর একাধিক গুণ থাকলেও তা যে পরিবারের সকলের কাছে প্রকাশিত হয়নি তার অন্যতম কারণ তাঁদের আচরণ।
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী বলেছেন, “…..ওঁদের পরিবার কেমন যেন ছাড়া ছাড়া একলষেঁড়ে ভাবে থাকতেন বলে বাইরের লোকের কাছে তেমন নামডাক ছিল না”। তবে নীপময়ীর গুণ পরিবারে একেবারে অজানা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের পর যশোরের ফুলতলির কিশোরী ভবতারিণীকে গড়েপিটে ঠাকুর বাড়ির আদবকায়দা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল নীপময়ীর ওপর। দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন স্বয়ং মহর্ষি।
নীপময়ীকে হেমেন্দ্রনাথ অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় তাঁর ভাল দখল ছিল। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে মিল্টনের “প্যারাডাইস লস্ট” এবং কালিদাসের “অভিজ্ঞান শকুন্তলম্” পড়তে দেখেছিলেন। দক্ষতা ছিল ছবি আঁকাতেও। ১৩০৭ সালের “পুণ্য” পত্রিকায় তাঁর আঁকা হরপার্বতী ছবিটি ছাপা হয়েছিল।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানিয়েছিলেন, “মায়ের আঁকা ছবি এখনও আমাদের তিন ভাইয়ের ঘরে কয়েকখানা আছে। কালিদাস পালের শিক্ষকতায় মা ইরুদিদির একটা ছবি এঁকেছিলেন। তাছাড়া একটা ক্লিওপেট্রার ছবি এঁকেছিলেন। White সাহেবের শিক্ষকতায় দিদির ছবি এঁকেছিলেন”। নীপময়ী দেবীর আঁকা ছবিগুলি আজ আর দেখার উপায় নেই। যত্নসহকারে রাখলেও আমাদের এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ছবি সংরক্ষণ খুব কঠিন। ছবি আঁকার চর্চা সেকালে বাংলাদেশে তেমন ছিল না।
নীপময়ী সে দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী। হেমেন্দ্রনাথের কড়া শাসন থাকায় তাঁর স্ত্রী ও কন্যারা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে খুব বেশি মেলামেশা করার সুযোগ পাননি। মৃণালিনী দেবীর চিঠিতেও আছে, “বাড়ির মধ্যে তাহলে তুমি আর নদিদি, সেজদিদিরা তো আলাদা মহলেই থাকেন”। এই দূরত্বের জন্যই নীপময়ী দেবীর প্রতিভা সকলের সামনে প্রকাশিত হয়নি। নীপময়ী অভিনয়ও করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “মানময়ী” নাটকে নীপময়ী শচীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
“সেজোকাকিমা নিজের বৃহৎ পরিবার সামলানো ছাড়া আর বিশেষ কোন দিকে মন দেবার অবকাশ পেতেন কিনা সন্দেহ”– বলেছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। এগারোটি সন্তানের জননীত্ব, প্রথম জীবনে হেমেন্দ্রনাথের কড়া শাসন এবং অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়ত নীপময়ী দেবীকে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। মন খুলে মেলামেশা করার সুযোগ তাঁর জীবনে তেমন ঘটেনি।
আটটি কন্যার মধ্যে হেমেন্দ্রনাথের প্রয়াণের সময় জ্যেষ্ঠা কন্যা প্রতিভা ছাড়া আর কারোরই বিবাহ হয়নি। সেই চিন্তাও ছিল। যদিও হেমেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকার সময়েও তাঁরা একটু আলাদা আলাদাই থাকতেন। অনেক গুণ থাকলেও নীপময়ী দেবী তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হতে পারেন নি। কিন্তু তাঁর কন্যাদের তিনি নানা গুণে গুণান্বিতা করে তুলেছিলেন। হেমেন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণের পরও তাঁর পুত্রকন্যারা যে শিক্ষাদীক্ষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন তার জন্য নীপময়ী দেবীর অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। সে কৃতিত্বও কম নয়।