রবীন্দ্রনাথের নৃত্যশিল্পী দৌহিত্রী: নন্দিতা দেবী

‘বেশ বুঝতে পারছি আমার এই শেষ বয়সে তোর খুকীর প্রেমে গীতিকাব্যের ডুবজলে আমাকে আবার একবার ঝাঁপ দিতে হবে। তাঁকে দেখবার জন্যে আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে। ‘যার জন্যে রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণ তিনি নন্দিতা দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী ও নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা নন্দিতার জন্ম ১৯১৬ সালে, জোড়াসাঁকোয়।

সীতা দেবীর স্মৃতিকথায় নন্দিতার শিশুকালের এক বর্ণনা আছে। ১৯১৭-১৮ সাল নাগাদ কবি শান্তিনিকেতন থেকে বাইরে কোথাও যাবার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছেন। শিশুকন্যা কোলে মীরা দেবীও দাঁড়িয়ে - ‘নাতনীকে আদর করিয়া পকেট থেকে সোনার ঘড়িটা বাহির করিয়া দেখাইলেন। শিশু ঘড়ির দিকে না তাকাইয়া একদৃষ্টে তাঁহার টুপির দিকে চাহিয়া রহিল। রবীন্দ্রনাথ বলিলেন, ‘তোমার এখনও অনেক শিক্ষা বাকি আছে। বুদ্ধি শুদ্ধি থাকলে দামি জিনিসটার দিকেই আগে তাকাতে'।

নন্দিতার কৈশোরের এক নির্মল ছবি আছে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মৃতিকথাতেও। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় শৈলজারঞ্জন ও আরো কয়েকজনকে যে গানগুলি শিখিয়েছিলেন তার অন্যতম ‘আধেক ঘুমে নয়ন চুমে’। নন্দিতা তখন বেশ ছোট' রবীন্দ্রনাথ চলে গেলে নিজের মনেই বলছিল - দাদামশাইয়ের গানের কথা বোঝা ভার।

Shrimati-Devi1

নয়নে আবার চুমো খায় নাকি কেউ’! মীরা দেবী ও নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। সম্ভবত মানসিকতার পার্থক্যের জন্যে তাঁদের একত্র বসবাসকাল দীর্ঘ হয়নি। মীরা দেবী পুত্রকন্যা-সহ শান্তিনিকেতনেই থাকতেন। নন্দিতা তাই শান্তিনিকেতনের মেয়ে, ঠাকুরবাড়ির একজন।

নাতনীর সঙ্গে সারা জীবন ধরেই রবীন্দ্রনাথের মধুর সম্পর্ক ছিল। কখনও মেমসাহেব, কখনও বৃদ্ধা ইত্যাদি নামে সম্বোধন করে তাঁকে লিখেছেন কবি - ‘এখন কেবল তোর ফেল হবার সংবাদের অপেক্ষা করছি - নইলে আমার মতো ইস্কুল-পালানো পরীক্ষা-এড়ানো ছেলে তোর কাছে যে মাথা তুলতে পারবে না’। এর অল্পদিন পরে রবীন্দ্রনাথের চিঠি গেল নন্দিতা দেবীর কাছে তাঁর প্রথম ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশের খবর নিয়ে।

নন্দিতার আগ্রহ ছিল নাচে। শান্তিনিকেতনে চিত্রাঙ্গদায় নতুন রূপ লাভ করা চিত্রাঙ্গদার ভূমিকা ছিল নন্দিতার বাধা। নাচের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল বর্ষামঙ্গল, ঋতুরঙ্গের সময় থেকেই। নাতনীর এই গুণটির বিশেষ তারিফ করতেন রবীন্দ্রনাথ। এক চিঠিতে মীরা দেবীকে লিখেছেন, ’মণিপুরের নবকুমার এসেছে, ছুটিতে থাকবে। নাচ শেখার দুর্লভ সুবিধে হয়েছে – এটাকে কিছুতেই উপেক্ষা করিসনে। বুড়ির যে স্বাভাবিক শক্তি আছে তাতেই তার যথার্থ আনন্দ ও সার্থকতা’।

আর একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'বিপদে পড়েছি। হঠাৎ সংবাদ পেয়েছি, একঝাঁক জাপানী আসছে আমাদের নাচের পরীক্ষার জন্যে। আগামী রবিবার পরীক্ষার দিন।.....শনি ও রবিবারের জন্যে বুড়িকে না পেলে এমন একটা লোক হাসানো হবে যা সমুদ্রপার হয়ে যাবে’। চন্ডালিকা, শ্যামা ও তাসের দেশেও নন্দিতার প্রধান ভূমিকা ছিল।

তাঁর নৃত্যচ্ছন্দে ও ভাবপ্রকাশের গভীরতায় চরিত্রগুলো যেন প্রাণ পেত। তাসের দেশের প্রথম অভিনয়ে চিঁড়েতনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও পরে তিনি হতেন হরতনী। অরূপরতন অভিনয়ের কথা হয়েছিল একবার, সেই প্রসঙ্গে নন্দিতাকে লিখেছিলেন কবি, 'সুরঙ্গমার পার্ট তত শক্ত নয়, সেটা তোকে শিখিয়ে দিতে পারব’।

শান্তিনিকেতনের নাচের নিজস্বতা বজায় রাখার কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নন্দিতাকে, ’যেখানে সেখানে যেমন তেমন করে নাচলে এ নাচের মূল্য কমে যাবে’। অন্য একটি চিঠিতে লিখেছেন, 'ওখানে বোধ হয় ওরা তোর নাচ দেখবার ফরমাশ করবে - চীনের মেয়েদের চেয়ে ভালো নাচা চাই'।

Shrimati-Devi2

১৯৩৬ সালের ২৫ এপ্রিল কৃষ্ণ কৃপালনীর সঙ্গে নন্দিতা দেবীর বিবাহ হয়। সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে এই বিবাহ সিউড়িতে রেজিস্ট্রি হয়। রবীন্দ্রনাথের সানন্দ সম্মতি ছিল এই বিবাহে। দৌহিত্রীর বিবাহ(বৈশাখ ১৩৪৩) উপলক্ষে কৃষ্ণ কৃপালনীর উদ্দেশে পৌত্রী নন্দিনীর জবানে লিখেছিলেন, ’আমি তোমার শ্যালী…'। ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নবদম্পতিকে - ‘কল্যাণীয় শ্রীমান কৃষ্ণ কৃপালানি ও কল্যানীয়া শ্রীমতী নন্দিতার শুভ পরিণয় উপলক্ষ্যে আশীর্বাদ’- ‘তোমাদের আকাশেতে নির্মল আলোর শঙ্খনাদ/তাঁর সাথে মিলে থাক দাদামশায়ের আশীর্বাদ'।। এই বিবাহে পৌরোহিত্য করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন।

বিয়ের পরেও নন্দিতা ও কৃষ্ণ কৃপালনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতনের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। নাতনীর সঙ্গে রসিকতা করেছেন নানান চিঠিতে। জীবনের শেষ অসুখে নন্দিতা অন্তহীন সেবায় ভরিয়ে তুলেছিলেন দাদামশাই রবীন্দ্রনাথকে। তৃপ্ত কবি লিখেছিলেন, 'দিদিমণি/ অফুরান সান্ত্বনার খনি।/ ….কোনো ভয় কোনো ঘৃণা কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি/ সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি’। ১৯৪১ সাল। শান্তিনিকেতন থেকে অসুস্থ কবিকে আনা হচ্ছে কলকাতায়। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যখন বোলপুরের দিকে গাড়ি যাচ্ছে তখন নতুন লাইটপোস্ট দেখে কবি বললেন নন্দিতাকে, 'তোদের পুরোনো আলো চলল। নতুন আলো আসছে’।

রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর ১৯৪২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কারাবাস করেন নন্দিতা। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের রাতে নন্দিতা কৃপালনী ও সুচেতা কৃপালনী উদ্বোধনী সঙ্গীত ‘বন্দেমাতরম্’ পরিবেশন করেন। আত্মপ্রচার বিমুখ নন্দিতা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে একমাত্র যিনি সেভাবে কোনো স্মৃতিকথা লেখেননি।

নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারীর ছাত্রী অথচ চীনাভবনের দেওয়ালে একটি ফ্রেস্কোয় শুধু ধরা আছে তাঁর কাজ। রেকর্ডে সমবেত সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক' ও 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’তে আছে তাঁর কণ্ঠ। ১৯৫০ সালে মৃণালিনী সারাভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা।

১৯৬০ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে ও দেশে গিয়ে "চিত্রাঙ্গদা" শিখিয়ে এসেছিলেন। কৃষ্ণ কৃপালনী সাংস্কৃতিক দপ্তরের অধিকর্তা থাকাকালীন নন্দিতা সর্বতোভাবে স্বামীকে সহায়তা করেছেন। "দেশ" পত্রিকায় দক্ষিণ আমেরিকা সফর বিষয়েও লিখেছিলেন। যদিও এসব তাঁর অভিজ্ঞতার তুলনায় কিছুই নয়।
ক্যান্সারের অপরিসীম রোগযন্ত্রণা সহ্য করে ১৯৬৭ সালে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই আত্ম উদাসীনার মৃত্যু হয়।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...