শান্তিনিকেতন ও ঠাকুরবাড়ির মীরা দেবী

“আমার জ্বর সেরে গেছে। এখন থেকে রান্না ও সেলাই শিখব, মেজমা বলেছেন।”
কাঁচা হাতের এই চিঠিটি রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন তাঁর মাতৃহীনা দশ বছরের কনিষ্ঠা কন্যা অতসীলতা। মীরা নামেই যাঁর পরিচিতি। ১৮৯২ সালের ১২ জানুয়ারি জন্ম মীরা দেবীর। বাবা, মা, দাদা, দুই দিদি ও ভাইকে নিয়ে একসঙ্গে অল্প কিছুদিন থেকেছিলেন শিলাইদহে। পদ্মা তীরে। এরপর কিছুদিন শান্তিনিকেতনে - “সেখানকার একটা ছবি মনে পড়ে - সরু এক ফালি বারান্দায় একটা তোলা উনুন নিয়ে মা বসে রান্না করছেন আর তাঁর পিসিমা রাজলক্ষ্মী, দিদিমা তরকারি কুটতে কুটতে গল্প করছেন।” মনে ছিল আরও কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিও।

শান্তিনিকেতনে কিছুদিন থাকার পর মৃণালিনী দেবীর অসুস্থতার জন্য তাঁকে কলকাতায় আনা হল। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিনি যখন মারা গেলেন মীরার বয়স তখন দশ বছর মাত্র। এর কিছুদিন পরে অসুস্থ রেণুকাকে নিয়ে কবি গেলেন আলমোড়ায়। মীরা রইলেন কবির মেজবৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর কাছে- “…বড়ো আনন্দে ও মেজমার আদরযত্নে সেই বাড়িতে দিন কাটিয়েছি। প্রকান্ড বাগান, তার এক ধারে একটি মসৃণ বড়ো গাছের তলা গোল করে বাঁধানো ছিল। সন্ধের আগেই সেখানে বসে মেজমা আমাদের খাইয়ে দিতেন ঘুমিয়ে পড়ব বলে।”

মাতৃহারা কিশোরী ভালবাসা পেয়েছিলেন সুগায়িকা অমলা দাশের কাছেও।
কিশোরীবেলা মীরা কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। সেখানেই তাঁর পড়াশোনা শেখা। ইংরেজি শিখেছেন মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, প্রাচীন রোমের ইতিহাস পড়েছেন অজিত কুমার চক্রবর্তীর কাছে আর ভয় পাওয়া বিষয় অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন ভূপেন সান্যাল। সর্বোপরি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ- “বাবা নিজের লেখাপড়ার কাজে ব্যস্ত থাকলেও তারই মধ্যে রোজ সকালে আমাকে নিয়ে পড়াতে বসতেন”। ‘গোল্ডেন ট্রেজারি' থেকে বেছে কবিতা পড়াতেন কবি।

এমনকি মীরা ভালো মুখস্থ করতে পারতেন না বলে রবীন্দ্রনাথ যেখানটা মীরার মনে পড়ত না, সেখানের ছবি মনে করিয়ে দিতেন তখন আস্তে আস্তে সবটা তাঁর মনে পড়ে যেত। মাতৃহারা কন্যার একাধারে মা ও বাবা দুই-ই হতে হয়েছে কবিকে। “বাবা কী আশ্চর্য রকম মনের কথা বুঝতে পারতেন”- কখনও যদি মন খারাপ করে বালিকা মীরা গিয়েছেন কবির কাছে, কিছু বলতে হত না, শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতেন কোথাও ব্যথা পেয়েছি- তখন সস্নেহে কাছে টেনে নিতেন। বাবার কাছে কখনও বকুনি খান নি মীরা কিন্তু কোনো অন্যায় করলে তাঁর মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারতেন, কাজটা ঠিক হয়নি। “বাবার কাছে এত স্নেহ পেয়েছি যে মা-র অভাব কোনোদিন বোধ করি নি”- বলেছেন মীরা দেবী।

জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও ছোটবেলায় থেকেছেন মীরা। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর স্মৃতিতে ছিল সেসব দিন- “রবিদাদার ছোট মেয়ে মীরা আমাদেরই সমবয়সী। আমার চেয়ে এক বছরের বড় ছিল বলে তাকে আমরা পিসী বলতে পারতুম না, নাম ধরে ডাকতুম। প্রতিমা দিদি আবার জোড়াসাঁকোতে ফিরে এলে আমাদের পিসী বলা অভ্যাস করালো।” কৈশোরের বেশি সময় কাটিয়েছেন শান্তিনিকেতনেই। রবীন্দ্রনাথ সহ কত গুণীজনের সাহচর্যে। রাজলক্ষ্মী দেবীর কাছে শিখেছেন সংসারের নানা কাজ। যেসব কাজ না জানা থাকায় সমস্যা হয়েছিল মীরার দিদি মাধুরীলতার। তাই তিনি মীরাকে বলতেন, “তোর কেমন মজা, সব শিখে নিচ্ছিস। আমার মতো পরে কষ্ট পেতে হবে না।”

১৯০৭ সালের জুন মাসের ৬ তারিখে নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মীরা দেবীর বিবাহ হল। অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী নগেন্দ্রনাথ বিলেত যাবার শর্তে মীরা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের রাতেই নগেন্দ্রনাথের আচরণে উপস্থিত সকলে বিরক্ত বোধ করেছিলেন।

উপবীত ধারণকে কেন্দ্র করে নগেন্দ্রর আচরণ শোভনতার সীমা লঙ্ঘন করেছিল। বিয়ের পর আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে ১৯১০ সালে দেশে ফিরে আসেন। স্বভাবত উদ্ধত নগেন্দ্রনাথ ছিলেন অসহিষ্ণু। শিক্ষা, শালীনতা ও সুরুচির যে আবহাওয়ায় মীরা বড় হয়ে উঠেছিলেন তার সঙ্গে নগেন্দ্রর কোনো মিল ছিল না। নীতীন্দ্রনাথ ও নন্দিতা - দুই সন্তানের জন্মের পরেও তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হল না। মীরা চলে এলেন শান্তিনিকেতনে।

রবীন্দ্রনাথ জোর করে মীরাকে পাঠিয়ে দেবেন এমন আশা করেছিলেন করেছিলেন নগেন্দ্রনাথ। কিন্তু নারাজ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “মীরার সঙ্গে তোমার লেশমাত্র বিচ্ছেদ হয় এ আমার কিছুতেই ইচ্ছাসম্মত নয়। ….তবু আমাকে পরম দুঃখে এটা স্বীকার করতে হচ্ছে। এবার মাদ্রাজে যখন দেখলুম মীরা তোমাকে ভয় করে, তোমার হাত থেকে প্রকাশ্যে অপমানের সংকোচে একান্ত সংকুচিত হয়, তখন স্পষ্ট দেখতে পেলুম তোমাদের দুজনের প্রকৃতির মূল সুরে মিল নেই।”

কোনোভাবেই স্ত্রী-কে কাছে আনতে না পেরে নগেন্দ্রনাথ আদালতে যাবার হুমকি দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ উত্তরে লিখেছিলেন, “তুমি এ সম্বন্ধে আদালতে নালিশ করতে চাও, মীরা যদি সেই আঘাতও সহ্য করতে সম্মত থাকে, তাহলে আমি কি করতে পারি? তুমি এ সম্বন্ধে তাকেই বরঞ্চ ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখো। যদি ভয় পেয়ে সে হার মানে তবে তাই হোক”। মীরা ভয় পান নি। দুই সন্তানকে নিয়ে আমৃত্যু থেকেছেন শান্তিনিকেতনে।

স্বামীর সঙ্গে তাঁর আর মিল হয়নি। মীরার জীবনের এই পরিণতির জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেকেই দায়ী করেছেন, “আমার জীবনে সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে আমি তোকে সুখী করতে পারলুম না”। এই না- পারার দহনে বহুদিন পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছেন কবি। চিঠিতে লিখেছেন, “তোর জন্য আমার মন দুশ্চিন্তায় পীড়িত হয়ে আছে। …সংসারে স্নেহ করলেও সুখী করবার ক্ষমতা কারো নেই। দুঃখ ভোগ সকলে্রই ভাগ্যে আছে। মনকে সেই দুঃখের উপর নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।”

শান্তিনিকেতনে মীরা কিছুদিন শিশুবিভাগে ছোটদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ইতিহাসের প্রতি আন্তরিক টান থাকায় একবার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সঙ্গে রাজশাহীর কাছে পাহাড়পুর স্তূপ ঘুরে পতিসরে ঠাকুর পরিবারের জমিদারিতেও গিয়েছিলেন। মৃণালিনী দেবীর খ্যাতি ছিল রন্ধনে। মীরা দেবীও যে সেই গুণের অধিকারী ছিলেন তা জানিয়েছেন ইন্দিরা দেবী, “…. রাঁধাবাড়া সম্বন্ধে কাকিমার খুব শখ ছিল। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা মীরাতেও তা সংক্রামিত হয়েছে”।

অল্প কিছু লেখালেখিও করেছেন মীরা। রবীন্দ্রনাথ যখন 'প্রবাসী’ পত্রিকার সমালোচনা বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন তিনি ওই পত্রিকায় প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বহু প্রবন্ধের সারসংকলন অনেককে দিয়ে করিয়েছিলেন। মীরা দেবী তাঁদের অন্যতমা। ‘ ভারতের ভাগবত ধর্ম’, ' হিন্দুধর্ম ও রাষ্ট্রনীতি’, ' হিন্দু মুসলমান সমস্যা’, 'প্রাচীন ভারতে বিদেশী', ‘মৌর্য্য সাম্রাজ্যের লোপ’, 'ধর্ম্ম ও বিজ্ঞান' ইত্যাদি সংকলন মীরা দেবীর করা। ভালবাসতেন বাগান করতে। অপরিসীম পরিশ্রমে ও গভীর আগ্রহে তিনি শান্তিনিকেতনের রুক্ষ লাল মাটিতে তিনি এক অপরূপ বাগান তৈরি করেছিলেন।

“কোনো কাজে যখন আমি মন বসাতে পারছিলুম না তখন এই বাগানের নেশা আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল”- বলেছেন তিনি। এই বাগানের জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়ির নাম রেখেছিলেন 'মালঞ্চ'।

দুর্ভাগ্য মীরার চিরসঙ্গী। ১৯৩২ সালে অগাস্ট মাসের ৭ তারিখে জার্মানিতে মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে ক্ষয়রোগে মৃত্যু হল মীরা দেবীর একমাত্র পুত্র নীতীন্দ্রনাথের।

একাত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথ কনিষ্ঠা কন্যাকে চিঠি লিখলেন, “…. নীতুর চলে যাওয়ার কথা যখন শুনলুম তখন অনেকদিন ধরে বারবার করে বলেছি, আর তো আমার কোনো কর্ত্তব্য নেই, কেবল কামনা করতে পারি এর পরে যে বিরাটের মধ্যে তার গতি সেখানে তার কল্যাণ হোক”।

মীরার একমাত্র কন্যা নন্দিতা ছিলেন কবির খুব কাছের। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনা যাঁরা সার্থক করে তুলেছিলেন নন্দিতা তাঁদের একজন। তাঁকে নিয়েই বেঁচেছিলেন মীরা। মাত্র একান্ন বছর বয়সে চলে গেলেন তিনিও।

সহ্য করার সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন মীরা দেবী। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে শৈশব, কৈশোরের দিনগুলি বড় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে। রোগশয্যার দীর্ঘ অবসরে সেই ফিরে দেখাই ছিল মীরা দেবীর কাছে একমাত্র আনন্দের। এক আশ্চর্য মায়ায় তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর অকালপ্রয়াত রানীদির কথা- যা এই স্মৃতিকথার সবচেয়ে বড় সম্পদ। সব হারানো এই নারী তাঁর স্মৃতিকথাটি তুলে দিতে চেয়েছিলেন 'বউঠান’ অর্থাৎ প্রতিমা দেবীর হাতে। কিন্তু চিরদুঃখী মীরা দেবীর এই চাওয়াটিও পূর্ণ হল না।
অবশেষে ১৯৬৯ সালে সকল দুঃখের অবসানে মৃত্যু এসে মীরা দেবীকে শান্তি দিল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...