ঠাকুরবাড়ির 'লাল' কন্যা


‘আমি যে পরিবারে জন্মেছিলুম সেটা আটপৌরে পরিবার ছিল না। প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের কোনো চিন্তা, কোনো অনুভূতিই এই বাড়িতে অপাংক্তেয় ছিল না।‘ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে এমন কথা বলেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই বোধহয় এই বাড়ির কন্যার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল অসহায় মানুষের যন্ত্রণাকে অনুভব করে তাদের পাশে দাঁড়ানো।

ব্যতিক্রমী এই কন্যা মঞ্জুশ্রী দেবী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা মঞ্জুশ্রী দেবীর জন্ম ১৯০৭ সালে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, '….১৯০৭ সালে আমার বড়ো ভাইঝি মঞ্জুশ্রী ওরফে মঞ্জুর জন্ম'।

গানে এবং অভিনয়ে দক্ষতা ছিল মঞ্জুশ্রীর। কলকাতার এম্পায়ার থিয়েটারে ‘বিসর্জন’ নাটকের তিন দিন অভিনয় হয়েছিল। অপর্ণার ভূমিকায় ছিলেন রাণু অধিকারী। একদিন তিনি অভিনয় করতে না পারায় রবীন্দ্রনাথের কথাতে মঞ্জুশ্রী অভিনয় করেন। এই নাটকে গুণবতীর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন মঞ্জুশ্রীর মা সংজ্ঞা দেবী। অসুস্থতার জন্য তিনিও একদিন অভিনয় করতে পারেননি।সেই চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন মঞ্জুশ্রী।

কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া দুটি চরিত্রে পরপর দুটি রাত্রে অভিনয় অত্যন্ত কঠিন কাজ। মঞ্জুশ্রী অনায়াসে সে কাজে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ‘রাজা ও রাণী’র রূপান্তর ‘ভৈরবের বলি’ নাটকে মঞ্জুশ্রী রাণী সুমিত্রার ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইউরোপ গিয়েছিলেন তিনি, কিছুদিন লন্ডনে লেখাপড়াও করেছিলেন।

১৯২৪ সালের ১০ মার্চ সন্ধ্যায় মহর্ষি ভবনে যামিনীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্জুশ্রী দেবীর বিবাহ হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, ’পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নব দম্পতি কে সময়োপযোগী একটি সুন্দর উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন।'

‘রাণু অধিকারী কে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'কাল সন্ধের সময় মঞ্জুর বিয়ে হয়ে গেল। আজ সকালে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। বিয়ের কিছুদিন আগে থাকতেই ওর কান্না শুরু হয়েছে। ওর কান্না দেখে বুঝতে পারি মেয়েদের পক্ষে প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাওয়া বলতে কতখানি বোঝায়।

এই বিবাহে রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবি অবলম্বনে কবিতা রচনা করে তাঁদের উপহার দিয়েছিলেন। কবিতাটি হল - 'ওগো বধূ সুন্দরী/নব মধু মঞ্জরী/ সাত ভাই চম্পার লহ অভিনন্দন/ পর্ণের পাত্রে/ফাল্গুন রাত্রে/স্বর্ণের বর্ণের ছন্দের বন্ধন’। পরবর্তী সময়ে এর রূপান্তর করে একটি গান তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

ক্ষিতীশপ্রসাদ পারিবারিক সূত্রে রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। অত্যন্ত মেধাবী ক্ষিতীশপ্রসাদ ১৯১৩ সালে ম্যাট্রিকে সপ্তম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীর অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে এমএসসি করেন। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক হন। কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ক্ষিতীশপ্রসাদ ১৯৪২ সালে নদীয়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন।

১৯৪০ সালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মেহনতি নারীদের সমস্যা সমাধানের জন্য 'মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ গড়ে তোলা হয়। মঞ্জুশ্রী চট্টোপাধ্যায় সূচনা থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কৃষ্ণনগরে থাকার সময় পঞ্চাশের ভয়াবহ মন্বন্তরের বিষয়ে সোমনাথ লাহিড়ীর একটি প্রবন্ধ পড়ে মঞ্জুশ্রী কলকাতার পরিস্থিতি বিষয়ে অবগত হন।

অসহায় জনসাধারণের সাহায্যার্থে বাড়িতে রিলিফ সেন্টার খুলেছিলেন। তিনি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির 'মুখপত্র' 'ঘরে-বাইরে' পত্রিকার সম্পাদিকা ও ছিলেন। ‘আত্মরক্ষা সমিতি সেই মেয়েদেরই প্রতিষ্ঠান - যারা সমাজে, সংসারে, অর্থনীতি আর রাজনীতি ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠা পায় না কোনদিন, বঞ্চিত হয় সকল রকম অধিকার থেকেই’ - এমনই ভেবেছিলেন তিনি।

কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে মণিকুন্তলা সেন, জলিমোহন কল প্রমুখের সঙ্গে মঞ্জুশ্রী চট্টোপাধ্যায়ও গ্রেপ্তার হলেন। জেলে সকলের সঙ্গে মঞ্জুশ্রী ও একান্ন দিন অনশন করেছিলেন।প্রায় একবছর তিনি জেলে ছিলেন। সব রাজবন্দীর মুক্তির জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা কমিটি গঠিত হলে ক্ষিতীশপ্রসাদ তার সভাপতি হন। এভাবেই সমাজসেবার নানা পর্যায়ে এই দম্পতি একসঙ্গে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন, 'জীবনের সম্মিলন থেকেই হৃদয়ের সম্মিলন হতে থাকে' - সেকথা এঁদের ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীন সত্য হয়েছিল।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক কমিউনিস্ট সন্তান সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 'বাড়ির আলো-বাতাসে আমার জীবন অত্যন্ত সহজ ভাবে দেশকে ভালোবাসতে শিখেছিল'। মঞ্জুশ্রী দেবীর ক্ষেত্রেও মনে হয় তাই হয়েছিল। না হলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কন্যা অনায়াসে কারাবাস করলেন কীভাবে? পরবর্তী জীবনে অবশ্য প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে খুব একটা যোগ ছিল না মঞ্জুশ্রী দেবীর। ১৯৮০ সালে তিনি প্রয়াত হন।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...