রবি পুত্রী মাধুরীলতা


"কাল রাত্তিরে বেলিটাকে স্বপ্নে দেখেছিলুম- সে যেন স্টিমারে এসেচে - তাকে এমনি চমৎকার ভাল দেখাচ্চে সে আর কি বলব…"। দূর দেশে যাত্রা তখন রবীন্দ্রনাথের। জাহাজে রাতের স্বপ্নে যে কন্যাকে দেখলেন কবি তিনি তাঁর প্রথম সন্তান মাধুরীলতা – কবির আদরের বেলা। ১৮৮৬ সালের ২৫ অক্টোবর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মাধুরীলতার জন্ম। "বেলা যেন মোমের পুতুলটির মতো হয়েছিল।

তাকে দেখতে প্রথম দিন যখন বাড়ির ভিতরে গেলুম তখন স্থির করলুম তার দৈনন্দিন জীবনী আমি রোজ লিখব। কিন্তু কয়েকদিনের বেশি সে সঙ্কল্প স্থায়ী হয়নি”, জানিয়েছেন ইন্দিরা দেবী। ছাব্বিশ বছরের তরুণ পিতা প্রথম সন্তানের দায়িত্ব কিশোরী বধূর ওপর চাপিয়ে সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেননি। শিশুকন্যাকে নিজের হাতে স্নান করানো, রাতে উঠে দুধ গরম করে খাওয়ানো সবই করেছেন পরম স্নেহে।

সন্তানদের শিক্ষা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটু অন্যরকম ভাবনা ছিল। বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি জোড়াসাঁকো বাড়িতেই একটা স্কুল খুলেছিলেন। সেখানে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা জনা পনেরো হলেও পড়াবার জন্য একজন বৃদ্ধ হেডমাস্টার ও দুজন শিক্ষক ছিলেন। তখন এদেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা সবেমাত্র শুরু হয়েছে।

সেই শিক্ষায় আস্থাশীল অবিনাশ বসু ও তাঁর স্ত্রী এবং রসময়বাবু হেডমাস্টার মশাইয়ের কাছে “ … ঘরোয়া ইস্কুলে আমাদের ভাইবোনেদের হাতে-খড়ি হয়েছিল মাত্র”, জানিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। রসময়বাবু দুপুরবেলা জেগে থাকতে পারতেন না।“ আমাদের মধ্যে দিদির দুষ্টুবুদ্ধি ছিল বেশি – কখন নিঃশব্দে পালিয়ে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে মাছ ভাজা, বেগুনি প্রভৃতি উপাদেয় খাবার নিয়ে এসে আমাদের মধ্যে বিতরণ করে আবার চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে পড়ত”। হঠাৎ জেগে হেডমাস্টারমশায় সব কটা ডেস্কের ডালা তোলা দেখে গলা খাঁকারি দিলে ডালা বন্ধ করে যে যার “টাস্ক” করতে শুরু করত।

বেশি বকাঝকা করলে মাধুরীলতা তাঁর মা মৃণালিনী দেবীর ডিবে থেকে চুরি করে আনা পান হেডমাস্টারমশাইকে দিয়ে বলতেন, ”মাস্টারমশায় চট করে ঘরে গিয়ে আপনার জন্য পান নিয়ে এলুম”। মাস্টারমশাই চুপ করে যেতেন। সত্যিকারের পড়াশোনা শুরু হল শিলাইদহে। রবীন্দ্রনাথ যখন সপরিবারে শিলাইদহে বাস করতে লাগলেন তখন “নির্জনতার মধ্যে দিদি আর আমি বাবা ও মা-কে আরো কাছাকাছি পেলুম। বাবা তখন আমাদের দুজনকে লেখাপড়া শেখাবার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিলেন” বলেছেন রথীন্দ্রনাথ।

শিলাইদহবাস কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হল না। অপরিসীম নির্জনতায় হাঁপিয়ে উঠেছিলেন মৃণালিনী দেবী ও মাধুরীলতা। তা ছাড়া মাধুরীলতার বিয়ের জন্যও চিন্তা ছিল। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের উদ্যোগে ও কবির বিশেষ আগ্রহে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে মাধুরীলতা দেবীর বিয়ে স্থির হল।

বিয়ের আগের দেখাশোনা ইত্যাদি বিষয়ে ইন্দিরা দেবী জানিয়েছেন, ”বেলাকে যখন তাঁর ভবিষ্যৎ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দেখতে আসে তখন রবিকাকার লালবাড়ির বারান্দায় তাঁদের খাওয়ানো হয়। আমরা মেয়ের দল পাশের ছোটো ঘর থেকে খড়খড়ে তুলে তাঁদের উঁকি মেরে দেখছিলুম"।

শরৎচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দর্শনে অনার্স নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে কেশব সেন স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। মাধুরীলতা যদিও কোনো বিদ্যালয়ে বিদ্যার্জন করেননি কিন্তু বাড়িতে তিনি যথেষ্ট লেখাপড়া করেছিলেন। “শিলাইদহে আমাদের যখন পড়াশুনা আরম্ভ হল, দিদি আমাদের ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে যেতে লাগলেন”- এই স্বীকারোক্তি করেছেন মাধুরীলতার পিঠোপিঠি ভাই রথীন্দ্রনাথ।

পনেরো বছরের মাধুরীলতার সঙ্গে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর বিয়ে হল ১৯০১ সালের জুলাই মাসে।
শরৎচন্দ্র তখন মজঃফরপুরের কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। মাধুরীলতাকে পৌঁছতে কবি গেলেন সেখানে। সেখানে থেকেই স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লিখলেন, “বেলা বোধ হচ্ছে এখন বেশ স্থির হয়ে নিজের ঘরকন্নাটি জুড়ে নিয়ে বসেছে। ….. যেখানে ওর বসবার ঘর স্থির হয়েছে সে ওর পছন্দ হয়েচে। সন্ধ্যাবেলায় শরতে ওতে মিলে কুমারসম্ভব পড়া হবে এই রকম একটা কল্পনাও চলচে”।

জামাই শরৎচন্দ্রের ওপর রবীন্দ্রনাথের গভীর আস্থা ছিল। “যাই হোক শরতের সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো - এমন সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য জামাই তুমি হাজার খুঁজলেও পেতে না। তা ছাড়া সংসারে ও প্রতিপত্তি লাভ করবে সেও নিশ্চয়। এখন বেলা যদি নিজেকে আপনার স্বামীর যোগ্য স্ত্রী করে তুলতে পারে তাহলেই আমি চরিতার্থ হতে পারি”। নিজের সন্তানদের মধ্যে মাধুরীলতা ছিলেন কবির সবচেয়ে প্রিয়, বলেছেন রথীন্দ্রনাথ। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বিবাহের পর কবি খুব কাতর হয়ে পড়েছিলেন।

মজঃফরপুর থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরে মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠিতে ধরা পড়ল সেই কাতরতা- “কাল সমস্তক্ষণ বেলার শৈশবস্মৃতি আমার মনে পড়ছিল। তাকে কত যত্নে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছিলুম। তখন সে তাকিয়াগুলোর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে কি রকম দৌরাত্ম্য করত - সমবয়সী ছোট ছেলে পেলেই কি রকম হুঙ্কার দিয়ে তার উপর গিয়ে পড়ত - কী রকম লোভী অথচ ভালমানুষ ছিল….” এইসব স্মৃতি যখন মনকে আচ্ছন্ন করেছে তখন কবির চিরবিশ্বাসী মন উচ্চারণ করেছে, “….সে সব কথা ও তো জানে না, না জানাই ভাল।

বিনা কষ্টে ওর নতুন ঘরকন্নার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে নিজের জীবনকে ভক্তিতে প্রেমে স্নেহে সাংসারিক কর্ত্তব্যে পরিপূর্ণতা দান করুক”। নিজেকে শান্ত করার এত চেষ্টা সত্ত্বেও আকুলতা বাধা মানে নি। মাধুরীলতাকে লেখা মৃণালিনী দেবীর এক চিঠিতে ধরা রইল সেই মন কেমনের কথা - “আজ উনি খাবার পর হঠাৎ বলে উঠলেন যে, 'চল তোমাতে আমাতে বেলাদের একবার দেখে আসি’।” যাওয়া অবশ্য শেষ পর্যন্ত হয়নি।

মজঃফরপুরে শরৎচন্দ্রের প্র্যাকটিস জমে উঠলেও, তাঁদের চলে আসতে হল কলকাতায়। ব্যারিস্টারি পড়তে শরৎ গেলেন বিলেতে। মাধুরীলতা শান্তিনিকেতনে ছোটদের পড়ালেন কিছুদিন। এই সময়েই শুরু হল তা্ঁর গল্প লেখা। শরৎচন্দ্র ফিরে এলে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হল জোড়াসাঁকোতেই।সেখানে থাকার সময় মীরা দেবীর স্বামী নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের আচরণে শরৎ-মাধুরী ক্ষুব্ধ হলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বিদেশে। দেশে ফিরে সব শুনেও কোন সমাধান না করে কবি চলে গেলেন শান্তিনিকেতন। সমস্যা জটিলতর হল।শরৎ- মাধুরী চলে গেলেন ডিহি শ্রীরামপুরে। শরৎচন্দ্রের প্র্যাকটিস জমে উঠল কলকাতাতেও।

কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লেন মাধুরীলতা। রথীন্দ্রনাথের কথায়, ”বাবা তখন শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় এসে রইলেন। প্রত্যহ দিদির কাছে যান। তাঁর সঙ্গে সারা দুপুর গল্প করেন, নতুন গল্পের প্লট তাঁকে বলে দেন…” । কিছুটা সেরেও উঠলেন মাধুরীলতা। কিন্তু জীবন সকলের দীর্ঘ হয়না। ১৯১৮ সালের ১৬ মে চলে গেলেন মাধুরীলতা। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে।
স্বল্পকালস্থায়ী জীবনে মাধুরীলতা কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন।

মজঃফরপুরে থাকতে লেখিকা অনুরূপা দেবীর সঙ্গে মাধুরীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাঁরা দুজনে মিলে তৈরি করেছিলেন লেডিজ কমিটি। এরপরে মেয়েদের জন্যে গড়ে তুললেন চ্যাপম্যান বালিকা বিদ্যালয় ।বিহারে তখন পর্দাপ্রথার রমরমা। মেয়েদের পক্ষে ঘরের বাইরে এসে স্কুলে ভর্তি হওয়া সম্ভব ছিল না। মাধুরীলতা তাই ছাত্রী জোগাড় করার জন্য অনুরূপাকে নিয়ে লোকের বাড়িতে যেতেন। সেখানকার মানুষনজনের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাঁরা গাড়ি থেকে নামার পর দুদিকে চাদর ধরে পর্দা বজায় রেখে তবে গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকতেন। মজঃফরপুরে বেশিদিন থাকলে হয়তো এসব কাজে তিনি আরও মন দিতে পারতেন।

রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন যে মাধুরীলতার বুদ্ধি ছিল তাঁদের সব ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে ছিল তাঁর লেখার হাত। ‘সবুজপত্র’, ' নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’ ও ' ভারতী’ পত্রিকায় মাধুরীলতার একাধিক গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সুরো, সৎপাত্র, চোর, চামরুর গল্প, মামা-ভাগ্নী ইত্যাদি গল্পে মাধুরীলতা নিজস্বতার সাক্ষর রেখেছিলেন। ‘স্বামীকে দেখিলে বারো আনা পিঠ খুলিয়া ষোল আনা মুখ ঢাকিবার জন্য ঘোমটা টানা কর্তব্য, সুরো সে শিক্ষা পায় নাই’ –এর মতো বাক্য এক তরুণীর সৃষ্টি ভাবতে অবাক লাগে।

মাধুরীলতার প্রয়াণের পর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “ওর ক্ষমতা ছিল কিন্তু লিখত না”। অকাল মৃত্যুতে শেষ হয়ে গেল সম্ভাবনাময় সংবেদনশীল এক সাহিত্যিকের জীবন। মৃণালিনী দেবীর অসমাপ্ত রামায়ণ, যা রবীন্দ্রনাথ তুলে দিয়েছিলেন মাধুরীলতার হাতে তা এবারও রয়ে গেল অ-সমাপ্ত।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...