“একটা ইংরেজি কাগজে পড়েছিলুম, 'the quality of centrality', সেই গুণটি আমার মায়ের ছিল; অর্থাৎ সকলকে নিজের চারিদিকে টেনে আনার ক্ষমতা।” - জ্ঞানদানন্দিনী প্রসঙ্গে অত্যন্ত যথার্থ এই মন্তব্যটি করেছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী।
১৮৫০ সালের ২৬ জুলাই যশোর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে জন্ম জ্ঞানদানন্দিনীর। তাঁর পিতা অভয়চরণ মুখোপাধ্যায় ও মা নিস্তারিণী দেবী।
তাঁদের বাড়িতে একটি পাঠশালা ছিল। সেখানেই তিনি অক্ষর পরিচয়-সহ সামান্য পড়াশোনা শিখেছিলেন। ১৮৫৯ সাল নাগাদ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যম পুত্রের সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
জোড়াসাঁকো বাড়ির পুরনো দাসীদের যশোর পাঠিয়ে বধূ পছন্দ করার প্রথাটি জ্ঞানদানন্দিনীর ক্ষেত্রেও বলবৎ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে বোধহয় দাসী পছন্দ করে গিয়েছিল।…….
বিয়ের পর বাসী বিয়েতে আমাকে মেয়েপুরুষ মিলে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকিতে নিতে এসেছিল।’ প্রথম প্রথম সেই বিশাল বাড়িতে বালিকার মন বসত না, কান্না পেত। তখন সান্ত্বনা পেতেন বড় ননদ সৌদামিনী দেবীর কাছে।
১৮৬০ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত যান। ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিলেতে ছিলেন। বালিকা বধূ তখন শ্বশুরবাড়িতে কিছুটা মানিয়ে নিয়েছিলেন।
‘ক্রমে ক্রমে যখন ওদের সঙ্গে মিশে গেলুম তখন অন্দরমহলে সুখেই ছিলুম। দাসীরা গঙ্গা নাইতে গেলে বলতুম ছোট ছোট নুড়ি কুড়িয়ে আনতে, তাই দিয়ে আমাদের ঘুঁটি খেলা হত। তাস খেলাও বোধ হয় শিখেছিলুম, তাতেও খুব আনন্দ পেতুম।’
কিন্তু এই গতিহীন জীবন তো তাঁর জন্য নয়। বিদেশে বসে সত্যেন্দ্রনাথ চিঠির পর চিঠিতে জ্ঞানদার সুপ্ত মনকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে গিয়েছেন। ভাই বর্জিনি,ভাই জ্ঞানদা, জ্ঞেনুমণি ইত্যাদি সম্ভাষণের মধ্যে তাঁদের সম্পর্কের নিবিড়তা অনুভব করা যায়।
বিলেতে নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা দেখে নিজের দেশের নারীদের শিক্ষা বিষয়ে যে সব ভাবনা সত্যেন্দ্রনাথের মনে এসেছিল তা তিনি সোজাসুজি ব্যক্ত করেছেন স্ত্রীর কাছে - ‘এখানকার জনসমাজের যাহা কিছু সৌভাগ্য, যাহা কিছু উন্নতি, যাহা কিছু সাধু, সুন্দর, প্রশংসনীয় - স্ত্রীলোকদের সৌভাগ্যই তাঁহার মূল।
আমাদের দেশে এরূপ সৌভাগ্য কবে হইবে?’ স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘…আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকেদের দৃষ্টান্তস্বরূপা হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরেই তাহার অনেক নির্ভর।’ বারবার মহর্ষির কাছে আবেদন করেছেন যাতে জ্ঞানদানন্দিনীকে বিলেত পাঠানো হয়। কিন্তু তা হয়নি।
গভীর দুঃখে স্ত্রীকে লিখেছেন, 'বাবামহাশয় চান আমি যেন অন্তঃপুরের মান মর্যাদার উপর হস্তক্ষেপ না করি। অর্থাৎ, তোমাকে চিরজীবনের মত চারি প্রাচীরের মধ্যে বন্ধ করিয়া রাখি।’ সমস্যা ছিল অন্যদিকেও। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত যাওয়ায় অসন্তুষ্ট সারদা দেবী জ্ঞানদানন্দিনীর গয়না নিয়ে ‘তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন শুনে রাগ করে মহর্ষি মাকে এক হীরের কন্ঠি’ দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী। সত্যেন্দ্রনাথের চিঠিতেও দেখি, ‘মা এখন কি তোমার সঙ্গে এক এক সময় কথা টথা কন, না আগের মতো পৃথকই থাকেন?’ এই সব সমস্যা আজ যত তুচ্ছ মনে হচ্ছে সেদিন তা ছিল না। যদিও জ্ঞানদানন্দিনী ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া।
বালিকা বধূ পড়তে বসতেন দেওর হেমেন্দ্রনাথের কাছে- ‘আমরা মাথায় কাপড় দিয়ে তাঁর কাছে বসতুম আর এক একবার ধমকে দিলে চমকে উঠতুম।' এ ছাড়াও বাড়িতে ‘বিবি’ অর্থাৎ বিদেশিনী গৃহশিক্ষিকা রেখেও লেখাপড়া শিখেছেন তিনি।শিখেছেন ইংরেজিতে কথা বলতে। চিন্তাধারাতেও ব্যতিক্রমী ছিলেন জ্ঞানদা।
এক চিঠিতে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তোমার অন্য বাড়িতে থাকার বিষয় কিছু স্থির করিতে পারিতেছি না – বাবা মহাশয় ইহার মধ্যে তো বাড়ী আসিবেন, না জানি তাঁহার কি মত?’ ১৮৬৮ সালে স্বল্প শিক্ষিতা তরুণী গৃহবধূর শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে একা থাকার চিন্তার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়।
সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়ে দেশে ফিরে আসার পর সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল হল মহারাষ্ট্রের নানা অঞ্চল। স্ত্রী-কে নিয়ে আসার অনুমতি মিলল মহর্ষির কাছ থেকে।
এবার সমস্যা - কী পোশাক পরে অন্তঃপুরের বাইরে আসবেন জ্ঞানদা আর কী ভাবেই বা উঠবেন জাহাজে? এতদিন শুধু শাড়িতে লজ্জা নিবারণ করা জ্ঞানদার জন্যে এল ফরাসী দর্জির তৈরী ওরিয়েন্টাল ড্রেস। এমনই জটিল ছিল তা যে জ্ঞানদা নিজে পরতেই পারলেন না।
এবার বাড়ি থেকে জাহাজে ওঠা নিয়ে জটিলতা শুরু হল। অবশেষে চিরকালের নিয়ম মেনে পালকি করে জাহাজে উঠলেন জ্ঞানদানন্দিনী। বম্বেতে মানেকজী করসেদজীর পরিবারের সদস্য হয়ে ছিলেন জ্ঞানদা।কত কিছু যে শিখলেন সেখানে - কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়া থেকে ওদের মত ডান কাঁধের ওপর দিয়ে শাড়ি পরাও- ‘পরে আমি সেটা বদলে আমাদের মতো বাঁ কাঁধে পরতুম, সায়া পরতুম।’
এই যে নতুন ধরণের শাড়ি পরার পদ্ধতি এ জ্ঞানদানন্দিনীর নিজের অবদান। সরলা দেবী জানিয়েছেন, “মেজমামী আর একটি জিনিসের প্রবর্তক - এই পরিবার থেকে আরম্ভ করে সমস্ত বাংলাদেশে। সেটি শাড়ি পরার ভঙ্গিমা পরিবর্তন।……এই রকমে পরা শাড়ির নাম ব্রাহ্মরা রেখেছিলেন ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’। ব্রাহ্ম মেয়েরা সবাই পরতে আরম্ভ করায় দেশের লোক তার নাম দিলে ‘ব্রাহ্মিকা শাড়িʼ।”
কাজের প্রয়োজনে সত্যেন্দ্রনাথকে মহারাষ্ট্রের নানা অঞ্চল ও অন্যত্র থাকতে হয়েছে। সঙ্গে থেকেছেন জ্ঞানদানন্দিনী। শিখেছেন নানান ভাষা। এমনকি হিন্দীও। একবার লাটসাহেবের বাড়ির দরবারে তাঁদের নিমন্ত্রণ ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ অসুস্থ থাকায় যেতে পারলেন না। পাঠালেন জ্ঞানদানন্দিনী কে, এক মেমসাহেবের সঙ্গে।
সভায় তাঁকে দেখে সবাই ভেবেছিল ভূপালের বেগম। ঘরের বউকে সভায় দেখে লজ্জায় সভা ত্যাগ করেছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর অন্তঃপুরেও কী আলোড়ন ওঠেনি? স্বর্ণকুমারীর লেখায় পাই, ‘বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বধূ ঠাকুরাণীর সহিত অসংকোচ খাওয়া দাওয়া করিতে বা মিশিতে ভয় পাইতেন।’
১৮৭৩ সালে পুণায় তাঁর প্রথম সন্তান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তার পরের বছর জন্ম ইন্দিরা দেবীর। এর কিছু পরে কবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৭ সাল নাগাদ অন্তঃসত্ত্বা জ্ঞানদানন্দিনীকে তিন সন্তানসহ এক ইংরেজ দম্পতির সঙ্গে বিলেত পাঠালেন সত্যেন্দ্রনাথ। বিলেতে অপরিণত অবস্থায় জন্মানো পুত্র সন্তানটির মৃত্যু হল। মারা গেলেন কবীন্দ্রনাথও। সত্যেন্দ্রনাথ তখন ভারতে। একা জ্ঞানদানন্দিনী সামলালেন সব।
বিলেত থেকে ফিরে জ্ঞানদানন্দিনী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ‘জন্মদিন’ পালনের সূত্রপাত করেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতে, নাটক করতে, জন্মদিন পালন করতে যেমন তাঁর আনন্দ ছিল, তেমনই তিনি আবার জোড়াসাঁকো বাড়ির একান্নবর্তী সংসার থেকে বেরিয়ে এসে পেতেছিলেন আলাদা সংসার।
যদিও পরিবারের প্রায় সবার সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল। সকলের সমস্যায় জ্ঞানদানন্দিনী থেকেছেন পাশে। বীরেন্দ্রনাথ উন্মাদ রোগগ্রস্ত হলে তাঁর তরুণী পত্নীর সহায় জ্ঞানদানন্দিনী, মৃণালিনী দেবীর অকাল প্রয়াণের পর রেণুকা যখন অসুস্থ তখন দুই শিশু সন্তানকে তাঁর কাছেই রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঊনষাট বছরের জন্মদিনেও তিনি দেওরকে ধুতি চাদর উপহার দিয়েছেন। একবার পরিবারের তিন প্রজন্মকে নিয়ে আয়োজন করেছিলেন দোল খেলার। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংস্কৃত নাটক পড়া ও অনুবাদ, অবনীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা শেখা সব কিছুতেই ছিল তাঁর উৎসাহ।
ছোটদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। জোড়াসাঁকো বাড়ির সে সময়ের অনেক ছোটদের লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বালকে’। সম্পাদিকা নিজে দুটি রূপকথার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। ‘টাকডুমাডুমডুম’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’।
ডেবাগোরিও সেগ্রিয়েভিচ্-এর সাইবেরিয়া থেকে পলায়নের কাহিনীর অনুবাদও করেছিলেন। ছোটদের জন্য তাঁর ভাবনা ধরা আছে তাঁর একাধিক প্রবন্ধে। করেছেন অভিনয়ও। ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে তাঁর রাণী সুমিত্রার অভিনয় নকল করেছিল সেকালের পাবলিক থিয়েটারের অভিনেত্রীরা।
প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস -এর পত্নী হলেও স্বদেশীয় ঐতিহ্যের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। জীবনের উপান্তে এসেও বলেছেন, ‘কোলদের সঙ্গে তাদের সুখদুঃখের কথা বলতে আমার বড় ভালো হলাগে।’ একানব্বই বছর বয়সে ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসের ১ তারিখে প্রয়াত হন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী।