স্কুলে পড়তে পড়তেই শিক্ষয়িত্রী: ঠাকুর বাড়ির হিরণ্ময়ী

‘প্রখরে মধুরে মিশ্রিত ছিলেন দিদি। যারা তাঁর মাধুর্যের স্পর্শে এসেছে, তারা চিরমুগ্ধ, অন্যেরা চিরক্ষুব্ধ’- হিরণ্ময়ী দেবী সম্পর্কে এমন অভিমত তাঁর ছোট বোন সরলা দেবীর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের জ্যেষ্ঠা কন্যা হিরণ্ময়ী দেবীর জন্ম ১৮৭০ সালে জোড়াসাঁকোয়।

স্বর্ণকুমারী বাংলার প্রথিতযশা লেখিকা। জানকীনাথ ঘোষালের জন্ম নদীয়ার জয়রামপুরে ঘোষাল বংশে। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পড়াকালীন রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ বন্ধুজনের সংস্পর্শে এসে জাতিভেদ প্রথা ও উপবীতধারণ বিষয়ে তাঁর বিরূপতা গড়ে ওঠে।

মহর্ষি যখন জানকীনাথের সঙ্গে স্বর্ণকুমারীর বিবাহের কথা উত্থাপন করেন তখন জানকীনাথ দুটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন হিরণ্ময়ী, “বিবাহ কালে পিতৃদেব মাতামহ পরিবারের ২টি রীতি গ্রহণ করেন নাই । ১। ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ ২। ঘরজামাই থাকা”। এই সময় জানকীনাথ ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। ১৮৬৮ সালে তাঁর সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। পিরালি ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যাকে বিবাহ করায় তিনি পরিবার থেকে বহিষ্কৃত হন।

বিবাহের পর তাঁরা প্রথমে শেয়ালদা বৈঠকখানা অঞ্চলে, পরে সিমলা অঞ্চলে ও তারপরে কাশিয়াবাগানে থাকতেন। জানকীনাথের বিলেত যাওয়া স্থির হওয়ায় তাঁরা জোড়াসাঁকোয় এলেন।" যে যোড়াসাঁকো আমার জন্মভূমি তারই অঙ্গীভূত হলুম এবার”। সরলা দেবীর এই কথাটি হিরণ্ময়ী দেবীর ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। হিরণ্ময়ী – সরলা তাই ঠাকুর পরিবারেরই সদস্য। ঠাকুর বাড়িরই মেয়ে - চিন্তা, চেতনা ও কাজে।

হিরণ্ময়ী দেবী বেথুন স্কুল থেকে ১৮৮২ সালে মাইনর পরীক্ষা পাস করেন। স্কুলে পড়ার সময়ে, তাঁর বিয়ের আগে দুই বোন হিরণ্ময়ী ও সরলা মিলে তাঁদের কাশিয়াবাগানের বাড়িতে মেয়েদের জন্য একটা পাঠশালা খুলেছিলেন। এই স্কুলের ছাত্রী ছিল প্রায় কুড়িজন- কেউ কুমারী, কেউ বা ছিল বালবিধবা।

শিক্ষয়িত্রী দুজনের মধ্যে হিরণ্ময়ীর বয়স তখন চৌদ্দ-পনেরো আর সরলার দশ-এগারো। বেথুনে পড়তে পড়তেই হিরণ্ময়ী দেবীর বিবাহ স্থির হল প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। “সিমলার বাড়িতে থাকতেই ফণিদাদা পিসেমশায়ের সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তখন থেকেই তাঁর দিদিকে বিয়ে করবার ইচ্ছে হয়"। হিরণ্ময়ী দেবীর বিবাহ হয়েছিল জোড়াসাঁকোর উপাসনা দালানে। বাসরে আনন্দ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ' বিবাহোৎসব’ নামে একটি গীতিনাটিকা লেখেন ও অভিনয় করান।

হিরণ্ময়ী ছিলেন স্বর্ণকুমারীর সব কাজের সঙ্গী। যদিও তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্ত্বও কম ছিল না। “দিদির ভিতর নেতৃত্ব ভাব ছিল বলেছি – সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাশক্তিও ছিল। তাঁর plan করা, তাঁর দ্বারা 'conducted tour’ –এ ফণিদাদার কলেজের ছুটির সময় আমরা বছর বছর দেশভ্রমণে বেরতে লাগলুম। ফণিদাদাকে টেনে হিঁচড়ে দিদিই নিয়ে যেতেন।

যা কিছু বন্দোবস্ত করার দিদিই করতেন – স্টেশনে স্টেশনে নামা, ব্রেকভ্যান থেকে লাগেজ নামান, সঙ্গী চাকরকে দিয়ে খাওয়া দাওয়ার যোগাড় করা - এ সবেরই কর্তা দিদি’। সরলা দেবীর এই বর্ণনা থেকে হিরণ্ময়ী দেবীর প্রাণোচ্ছ্বলতা ও কর্মদক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর পিতৃপরিবারপ্রীতি। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বলেছেন, 'হিরণ্ময়ী দেবীর একটি বিশেষ গুণ ছিল – সেটি তাঁর অনন্যসাধারণ পারিবারিক স্নেহ ও কর্তব্যনিষ্ঠা। পিতা-মাতার প্রতি অসীম ভক্তি তাঁহার প্রতি কাজে পরিস্ফুট হইত’।

হিরণ্ময়ী ছিলেন অত্যন্ত স্নেহময়ী। তাঁর ছোটবোন সরলাদেবী লিখেছেন, 'দিদির স্নেহে আমার মাতৃস্নেহের অভাব অনেকটা পূর্ণ হয়েছিল। আমার তখন যা সাধ হত তাঁকে ধরলেই পেতুম’। এত জীবনীশক্তি ছিল যাঁর, তিনি কিন্তু খুব বেশি লেখালেখি করেন নি।যদিও ঠাকুর বাড়ির নিজস্ব পত্রিকা 'ভারতী’ র ভার তিনি নিজে তুলে নিয়েছিলেন।

এছাড়া ছিল স্বর্ণকুমারী দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘সখিসমিতি’র দায়িত্ব। এই দুটি ক্ষেত্রেই তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলা ১৩০২ সন থেকে ১৩০৪ সন পর্যন্ত ' ভারতী’ র যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন হিরণ্ময়ী ও সরলা দেবী। সরলা দেবী তখন মহিশূরে। তাই নামে সম্পাদিকা থাকলেও সম্পাদনার সব কাজ হিরণ্ময়ীকেই করতে হত। ‘ ভারতী'র সঙ্গে তাঁর ছিল প্রাণের যোগ। পত্রিকার মান উন্নত করার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে এর সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলেন। প্রথমে রবীন্দ্রনাথ রাজি হন নি । কিন্তু কিছুদিন পরে তাঁকে দায়িত্ব নিতেই হল। আনন্দিত হিরণ্ময়ী জানালেন,” তিনি ‘ভারতী’ র সম্পাদনা ভার গ্রহণ করিতে অর্থাৎ লিখিতে ও লেখা নির্বাচন করিতে সম্মত হ ইলেন”। ম্যানেজারি করা, প্রূফ দেখা, লেখা সংগ্রহ করার ভার অবশ্য হিরণ্ময়ী দেবীর ওপরেই থাকল। এত কাজেও আনন্দিত ছিলেন 'ভারতী’র ভার গ্রহণ করেছিলেন তারপর কি হবে সে চিন্তা হিরণ্ময়ীর থাকলেও তিনি কখনও ‘ভারতী’কে পরিত্যাগ করেননি। তাঁর জীবনকালে 'ভারতী’ বন্ধ হয়নি।

হিরণ্ময়ীর নিজস্ব লেখালেখির বৃত্তটি খুব বড় নয়। “কিছু প্রয়োজনীয় সাময়িক তথ্যের ইংরেজি হতে অনুবাদ করে বাঙলা পাঠকের সহজসাধ্য করা তাঁর কাজ ছিল’ - বলে জানা যায়। তাঁর নিজস্ব সৃজনের মধ্যে ছিল কিছু সনেট - আন্তরিক ও মৌলিক। সনেটগুলি প্রসঙ্গে সরলা দেবী বলেছিলেন, ”যেমন কারো কারো গানের গলা মিষ্টি ও করুণ, অথচ সে বড় গাইয়ে নয় - তাঁর কবিতাগুলি ছিল সেইরকম সুমিষ্ট ও সকরুণ”।

স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রভাবে হিরণ্ময়ীও থিয়সফিতে আগ্রহী হয়েছিলেন। মহিলা থিয়সফিস্ট সভা ভেঙে যাবার পর ১৮৮৬ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী গড়ে তোলেন 'সখিসমিতি' -এর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত অসহায় বাঙালি বিধবা ও কুমারী কন্যাদের সাহায্য করা ও সুশিক্ষিত করে তোলা। অনেক বছর কাজ করার পর 'সখিসমিতি’র যখন জীর্ণাবস্থা তখন এর আদর্শটি বজায় রাখার জন্য হিরণ্ময়ী দেবী ১৯০৬ সালে বিধবা শিল্পাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৫ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এটি যথাযথভাবে পরিচালনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই সংস্থার নাম দেওয়া হয় 'হিরণ্ময়ী বিধবা শিল্পাশ্রম’।

'নিজের জগৎ আমি রচনা করিব নিজে/ কি অভাব মোর - আমি কবি’- লিখেছিলেন হিরণ্ময়ী। সমাজসেবামূলক নানা কাজে যুক্ত থেকে বহির্জগতে তিনি নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তেমনই ঘরেও তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন আপন স্থান। সমালোচক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর মতে,'সন্তানগণের শিক্ষার জন্য তিনি শুধু অর্থব্যয় করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন না, নিজে নিকটে বসিয়া তত্ত্বাবধান করিতেন’- যা সেকালে নিতান্তই দুর্লভ। দুটি পুত্র ও একটি কন্যাকে রেখে ১৯২৫ সালের ১৩ ই এপ্রিল হিরণ্ময়ী দেবী প্রয়াতা হন। হিরণ্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর মা স্বর্ণকুমারী দেবী স্নেহার্ঘ্য দিলেন এই বলে, “আজ আমিই মাতৃহারা হলাম”।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...