রামমোহন রায়ের বংশজা ও ঠাকুরবাড়ির বধূ: হেমলতা দেবী

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী হেমলতা দেবীর জন্ম ১৮৭৩ সালে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পৌত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয়া পত্নী হেমলতা দেবীর পিতা ললিতমোহন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন রামমোহন রায়ের বংশের। দ্বিপেন্দ্রনাথের প্রথমা পত্নী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নলিনী দেবীর মা সন্তানদের ছোট রেখে প্রয়াত হন।

তাঁর মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যেই ১৮৯১ সালের ২৩ এপ্রিল দ্বিপেন্দ্রনাথ হেমলতা দেবীকে বিবাহ করেন। অত্যন্ত মিশুকে স্বভাবের সুকন্ঠী সুশীলা দেবী পরিবারের সকলের প্রিয় থাকায় এই বিবাহকে জোড়াসাঁকো বাড়ির অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথায় আছে, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীও প্রথমে এই বিবাহে খুশি হননি এবং হেমলতা দেবীর সঙ্গে ভাল ভাবে কথা বলেননি।

ঘটনাটির অনেক কাল পরে স্মৃতিকথা লিখতে বসে ইন্দিরা স্পষ্ট লিখেছেন, 'কিন্তু (গুরুজনকে সমালোচনা করার দোষ মাথা পেতে নিয়েও) আমি বলি, সেটা তাঁর ভাল কাজ হয়নি। কারণ নতুন বউয়ের কী দোষ? সে বেচারার তো এই প্রথম বিয়ে। নববধূর আদর তো তার প্রাপ্য।‘

হেমলতা দেবীর দুই দাদার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বিবাহ হয়েছিল। তাই জোড়াসাঁকোয় তিনি আগেই এসেছেন। তবু বধূরূপে তখন এলেন তখন সাদর আহ্বান না পাবার দুঃখ তিনি কখনও প্রকাশ করেননি। নিজের কোনো সন্তান ছিল না তাঁর। কিন্তু দিনেন্দ্রনাথ ও নলিনী দেবীর ‘মা’ হয়ে উঠতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

thakur

তাঁর লেখা ‘দেহলি’ ছোট গল্প সংকলনটি তিনি 'দিনু নলিনী'কে উৎসর্গ করেছিলেন। পিতৃগৃহে থাকতেই তিনি বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও শিক্ষা করেছিলেন জ্যোতিষশাস্ত্র। যা সেকালের পক্ষে ছিল ব্যতিক্রম। বিয়ের পরে মিস ম্যাকস্কেল, পিয়ার্সন, অ্যান্ড্রুজ এবং রবীন্দ্রনাথের কাছে ইংরেজির পাঠ গ্রহণ করেছিলেন হেমলতা।

তাঁর আগ্রহ ছিল সাহিত্যচর্চাতে।একাধিক গল্প ও কবিতা লিখেছেন তিনি। তাঁর ছোট গল্প পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'তোমার ছোট গল্পগুলি পড়তে আমার খুব ভাল লাগল। কী মানবচরিত্রের কী তার পারিপার্শ্বিকের চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ছোট গল্প এবং কবিতার ভাষা সহজ, সরল, জটিলতাহীন।

একটি সন্ধ্যায় মোর সুন্দর করিয়া / একটি তন্দ্রার ঘোর স্বপনে ভরিয়া / এস হে প্রাণের মাঝে পরম সুন্দর / ক্ষণতরে তব হেরে জুড়াক অন্তর / একটি পরাণে ক্ষণ-মিলনের সুখ / সহিতে পারে যে চির বিরহের দুখ। ‘তিনি কয়েকটি গান ও লিখেছেন। তাঁর মধ্যে ‘ওহে সুনির্মল সুন্দর উজ্জ্বল শুভ্র আলোকে’ ও 'বালক প্রাণে আলোক জ্বালি’ গান দুটি তে রবীন্দ্রনাথ সুর দিয়েছিলেন। ‘আমি আর কিছু না জানি’ গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরারোপিত। এছাড়া ইন্দিরা দেবী ও সূরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কয়েকটি গানে সুর দিয়েছেন।

হেমলতার ধর্মপরায়ণ মন আকৃষ্ট করেছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে। হেমলতার পিতা ছিলেন ত্রৈলঙ্গস্বামীর শিষ্য। দাদা প্রথমে থিয়সফিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে শিবনারায়ণ স্বামীর অনুগামী হন। হেমলতাও শিবনারায়ণ স্বামীকে গুরু মানতেন। রামমোহন রায় ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সাধনার প্রতিও তাঁর সশ্রদ্ধ মনোভাব ছিল। অন্যান্য ধর্ম বিষয়ে তাঁর ঔৎসুক্য ও শ্রদ্ধা ছিল। সুফিবাদের প্রতি তিনি আগ্রহী ছিলেন। ‘আফ্রিকায় ইসলাম' নামে একটি প্রবন্ধ তিনি অনুবাদ করেছিলেন।

হেমলতার এই ধর্মসাধনা মহর্ষিকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রতিদিন দুপুরে তিনি হেমলতা দেবীর সঙ্গে এক ঘন্টা ধর্মালোচনা করতেন। নিজের দীক্ষার আংটি তিনি হেমলতা দেবীকে দিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ক নানা প্রবন্ধ লিখেছেন হেমলতা। হিন্দু ধর্মের প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তাঁর দর্শন চিন্তার ছাপ আছে তাঁর ‘দুনিয়ার দেনা’ গল্পগ্রন্থে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে লীলা পুরষ্কারে সম্মানিত করেছিল।

সাহিত্য রচনা, আধ্যাত্মচিন্তা ছাড়াও হেমলতা প্রত্যক্ষভাবে সমাজসেবার কাজ করেছেন। মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা ও তাদের সমস্যা অনুধাবন করা ছিল তাঁর আজীবনের ব্রত। সখী সমিতি, নারীশিক্ষা সমিতি, হিরণ্ময়ী শিল্পাশ্রম ও ভারত স্ত্রীমহামণ্ডলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯২৫ সালে সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর গুরুসদয় দত্তের অনুরোধে তিনি এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতির মুখপত্র ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকার সম্পাদনাও তাঁর ওপর ছিল। এ ছাড়া শান্তিনিকেতনের ছেলেদের দেখাশোনার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। যুক্ত থেকেছেন আলাপিনী মহিলা সমিতির সঙ্গেও। ইউরোপের নারী স্বাধীনতা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের কাহিনিতে উৎসাহিত বোধ করে তিনি সে দেশে যান। যদিও ইউরোপ তাঁর চিন্তায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে নারীর আদর্শ, ত্যাগ ও পরহিতই ছিল।

হেমলতা দেবীর অন্যতম অবদান অনবদ্য সব স্মৃতিকথা। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথের জীবনের এমন সব কাহিনি তিনি লিখে রেখে গিয়েছেন যা শুধু সুখপাঠ্য নয় অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ। অসামান্য দুই ব্যক্তির ঘরোয়া জীবনছবি গভীর আন্তরিকতায় তিনি ধরে রেখেছেন। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় যে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর কবি বহু বছর নিরামিষভোজী ছিলেন।

সেই সময় জমিদারি কার্যের সূত্রে রবীন্দ্রনাথকে মাঝে মাঝে পতিসরে যেতে হত। কবির শাশুড়ি তখন তার পুত্রের কর্মস্থল পতিসরে থাকতেন। তিনি স্বহস্তে মাছের নানা পদ রান্না করে জামাতার পাতে দিলে কবি ‘না’ বলতে পারতেন না। কন্যা নেই পাছে তিনি দুঃখ পান ভেবে খেয়ে নিতেন। অথবা চিরশিশু দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ যে মোচার ঘন্টে গরম মশলার গন্ধ পেলে মহা চেঁচামেচি জুড়ে বলতেন, 'কোথা থেকে কতকগুলো মাথাঘষা বেটে মোচার ঘন্টে ঢুকিয়েছো।

কিছু জানো না কী করে করতে হয়।‘ কিংবা লুচির গায়ে ঘি লেগে থাকায় জল দিয়ে লুচি ভেজে আনতে বলতেন। হেমলতা দেবী শুকনো ময়দা দিয়ে লুচি বেলে, ভেজে নিয়ে এলেন, খাওয়া হয়ে গেলে হেমলতার মুখে সব শুনে অট্টহাস্যে বললেন, 'তাই তো! গরম জলে ময়দা দিলে গুলে কাই হয়ে যাবে তো বটেই।

‘এই সব ঘরোয়া কথার ঐতিহাসিক মূল্যও কম নয়।
স্বামী ও শ্বশুরের মৃত্যুর পর তিনি জোড়াসাঁকোয় কিছুদিন কাটিয়ে পুরী চলে যান। ১৯৬৭ সালে এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী প্রয়াত হন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেও তাঁর মতো কর্মিষ্ঠা রমণী আর কেউ ছিলেন না।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...