অবন-ভগিনী "বিনয়িনী"

"গিন্নী সৌদামিনী ছিলেন বড়লোকের ঘরের বৌ। তবু অনেক কিছু জীবনে সইতে হয়েছিল তাঁকে। সংসারের নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে দিয়ে তিনটি শিশুপুত্র আর দুটি বাচ্চা মেয়ে নিয়ে অল্পবয়সে বিধবা হলেন" - পুরাতনী কথা বলতে গিয়ে এমনই বলেছিলেন প্রতিমা দেবী। সৌদামিনী অর্থাৎ গগনেন্দ্রনাথ-সমরেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা। আর বাচ্চা মেয়ে দুটির একজন হলেন বিনয়িনী দেবী-প্রতিমা দেবীর মা আর তাঁর ছোট বোন সুনয়নী দেবী।

বাংলা ১২৮০ সনে জোড়াসাঁকোতে বিনয়িনী দেবীর জন্ম। কেমন কেটেছিল তাঁর শৈশব? মা সৌদামিনীর কথামতো ভোরবেলায় উঠে বাগান থেকে ফুল কুড়িয়ে আনতেন বিনয়িনী-সুনয়নী দুই বোন। কার্তিক মাসে শ্রীধর ঠাকুরের পুজোর জন্য ভোর ছটার মধ্যে তাঁরা ফুল তুলে নিয়ে যেতেন ঠাকুর ঘরে। তাঁদের বড় পিসি কাদম্বিনী কোনোদিন হলদে কলকে, কোনোদিন সাদা রজনীগন্ধা, কোনোদিন রক্তকরবী দিয়ে ঠাকুরকে সাজিয়ে দুই বোনকে দেখাতেন। এই জীবনধারা ৬ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির নিরাকার ব্রহ্মোপাসনা থেকে ছিল অনেক যোজন দূরের।

নিজেদের মধ্যে খেলতেন দুই বোন। মাঝে মাঝে খেলায় যদি তাঁদের ছোটদাদা অবনীন্দ্রনাথ যোগ দিতেন তখন কখনো কখনো বেঁধে যেত মহা শোরগোল। “সুনয়নী বিনয়িনী ছোট বোন - তাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে খেলনা একটা ভেঙে গেল কি তারা কাঁদতে শুরু করে দিলে, "অ্যাঁ, অবনদাদা আমাদের পুতুল ভেঙে দিলে।" সঙ্গে সঙ্গে বকুনি জুটত অবনীন্দ্রনাথের।

বাবা গুণেন্দ্রনাথের আদরের দুই কন্যা, তাদের জন্য তিনি কিনেছিলেন “একটি ভারি সুন্দর ছোট্ট টাট্টু ঘোড়ার গাড়ি। সেটি ছিল ছোটলাটসাহেবের মেমের, নিলামে কিনেছিলেন বাবামশায়। সে কি আমাদের জন্যে? মোটেও তা নয়। কিনেছিলেন মেয়েদের জন্যে, সুনয়নী বিনয়িনী গাড়িতে চড়ে বেড়াবে।" – বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ।

৬ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি অর্থাৎ মহর্ষিদেবের বাড়ি লাগোয়া এই ৫ নম্বর বাড়ির চালচলন ছিল আলাদা। এ বাড়িতে ছিল পুজোপার্বনের ঘটা। দুর্গাপূজোয় বিনয়িনীরা যেতেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি - ঘেরাটোপওয়ালা পালকিতে । সেকালের মেয়েরা ছিল যেন অন্তঃপুরের আসবাব । বাইরে পুরুষদের ছিল পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। ছেলেমেয়েদের হাওয়া বদলানোর জন্য বজরা করে যাবার সময় ছেলেদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবে তাদের আত্মীয়দের ভরসায় রেখে যাওয়া হলেও মেয়েরা যেত সঙ্গে।

তাদের পড়াশোনা নিয়ে তেমন ভাবনাচিন্তা ছিল না। এমনই একবার তারা বজরায় গেলেন মুর্শিদাবাদ । পথে দেখলেন হুগলির ইমামবাড়া, হংসেশ্বরী মন্দির। কেনা হল কৃষ্ণনগরের পুতুল আর শান্তিপুরী ফেণীবাতাসা “দুই বোনের সমস্ত দিন মন পড়ে থাকত সেগুলির উপর। বারবার করে দেখা আর নেড়েচেড়ে তুলে রাখা - এই ছিল সমস্ত দিনের কাজ”। মাসখানেক চলল এই জীবন। তারপর আবার জোড়াসাঁকো।

এরপর যাওয়া হল গঙ্গার ধারে নতুন কেনা ২২ বিঘের বাগানে। সেখানে অনেক হাসি, অনেক আনন্দময় মুহূর্তের শেষ হল গুণেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে। আবার জোড়াসাঁকো। এই পরিস্থিতিতে “মা সৌদামিনীই তখন তাদের একমাত্র অভিভাবিকা” - বিয়ে হল বিনয়িনী দেবীর। না, জাঁকজমক হল না মোটেও। পাত্র অবশ্য ঠিক করা ছিল আগেই - প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র বংশ। সে বাড়ির চালও ছিল হিন্দুমতের, দোল- দুর্গোৎসবের ঘটা ছিল বিস্তর।

বিনয়িনীর লেখায় ধরা আছে সেসব ছবি - “…তখন সন্ধ্যায় আরতি আরম্ভ হল, চারজন ব্রাহ্মণব্রতী এসে বসলেন। দুইজন চন্ডীপাঠ করতে আরম্ভ করলেন আর একজন পুরোহিত ঠাকুরকে পুঁথি দেখে মন্ত্র বলে দিতে লাগলেন। সেই আশী বৎসরের পুরোহিত ভক্তিপূর্ণ হয়ে মা-কে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। রূপোর প্রদীপদানীতে ১০০৮ ঘৃতপ্রদীপ দিয়ে রূপোর ঘন্টা বাজিয়ে আরতি আরম্ভ হল। প্রতিমার দু পাশে মস্ত দুইটা পিতলের প্রদীপ, তার বুক পর্যন্ত উজ্জ্বল। প্রদীপে একসের ঘৃত ধরে। এইরূপ প্রদীপ তিনদিন তিনরাত জ্বলতে লাগল।"
‌‌

নিজের কথা তেমন বলেননি বিনয়িনী। তবু অনুভব করা যায় শেষেন্দ্রভূষণের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবন ছিল সুখের। একসঙ্গে তাঁরা বেশ কিছু জায়গায় বেড়াতেও গিয়েছিলেন। এমনই এক ভ্রমণছবি পাওয়া যায় অবনীন্দ্রনাথের চিঠি থেকে। যে চিঠিতে অবনীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য অনুভুতি ধরা আছে। “কাশী থেকে তোমার চিঠি যথাসময়ে পেয়েছি। সারনাথ অতি আশ্চর্য জায়গা।….….জায়গাটা প্রথম থেকেই আমার খুব চেনা চেনা বোধ হয়েছিল।

আমার মনে হল যে মন্দিরের কোণে কুয়োটার ধারে আমার দোকান ঘর ছিল সেখানে বসে আমি মাটির পুতুল আর পট বিক্রি করছি….”। ৫ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়িতে বিখ্যাত সব শিল্পীদের পাশে বিনয়িনী দেবীর কথা কজনের জানা? প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তাঁর আত্মস্মৃতির ছত্রে ছত্রে এক অনুভূতিপ্রবণ দরদী মনের পরিচয় বিস্মিত করে। শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ যাঁর কাছে মনের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন তিনি যে সাধারণ নন তা সহজবোধ্য।

এভাবেই জীবনযাপন করছিলেন বিনয়িনী। এরই মাঝে বিয়ে হল কন্যা প্রতিমার। বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই প্রতিমা দেবীর স্বামী নীলানাথ গঙ্গায় সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবে মারা গেলেন। প্রতিমা ফিরে এলেন জোড়াসাঁকোয়। কন্যার অকাল বৈধব্য বিনয়িনীকে অবশ্যই আলোড়িত করেছিল। কিন্তু তখনও তাঁর মন সংস্কারের বেড়া অতিক্রম করতে পারেনি।

১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথ কৃষিবিদ্যা শিখে দেশে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ”তোমাদের উচিত প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়া। বিনয়িনীকে বল যেন অমত না করে”। বিনয়িনীর পক্ষে সে কাজ সহজ ছিল না। উদ্যোগ নিলেন গগনেন্দ্রনাথ। ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পুনর্বিবাহ হল প্রতিমা দেবীর।

জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলে, সংসারের দায়-দায়িত্ব থেকে কিছুটা অব্যাহতি পেয়ে বিনয়িনী বসেছিলেন আত্মকথা লিখতে। খাতার ওপর যদিও লেখা ছিল ১৯১৬-১৯১৭ কিন্তু তাঁর নিজের কথা তিনি শুরু করেছিলেন মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগে। "কাহিনী" নামের সেই স্মৃতিকথায় বিনয়নী অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় শৈশবস্মৃতি, শ্বশুরবাড়ির কথা,জীবনের নানা অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করেছেন।

বিখ্যাত দাদাদের এবং গুণী বোনের আড়ালে থাকা বিনয়িনীও যে কম গুণী ছিলেন না তার প্রমাণ এই  "কাহিনী"। স্বামীর মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে যিনি লিখতে পারেন, ”মনে হল এই যে যাওয়া আসা এ তো কতকগুলো তৃণগুচ্ছ নদীর ঢেউয়ে কখনও একত্র হচ্ছে আবার সরে যাচ্ছে। এর জন্যে এত কাতরতা কেন”? এই উপলব্ধিতে কিভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি কে জানে! তবে জীবনের শেষপ্রান্তেও তিনি এই অনুভূতিতে স্থির ছিলেন।

বিনয়িনী দেবীর মৃত্যুর পর প্রতিমা দেবীকে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ”তোমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মনে আঘাত পেয়েছি। সেদিন তোমার মা যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখন তাঁর মধ্যে এমন একটি গভীরতা দেখেছিলুম, সাধনার এমন একটি সহজ সুন্দর রূপ তাঁর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল যে আমি আশ্চর্য হয়েছিলুম।.. এইবার এই দিক দিয়ে বিনয়িনী আমার হৃদয়ের খুব কাছে এসেছিলেন”। রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি যে সাধারণ নন তা সহজেই অনুভব করা যায়। ১৯২৪ সালে বিনয়িনী দেবী প্রয়াত হন।।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...