রবীন্দ্রনাথের ছোড়দিদি বর্ণকুমারী দেবী

কিছু কিছু মানুষ থাকেন বেঁচে থাকতেই তাঁরা বিস্মরণের প্রান্ত ছুঁয়ে ফেলেন। এমন নয় যে, তাঁদের সঙ্গে পরিবারের অন্য কারোর যোগাযোগ থাকে না বা দুঃখে, সুখে সঙ্গে থাকেন না কিন্তু আলাদা করে তাঁদের কথা যেন আর বলা হয়ে ওঠে না। এমনই একজন রবীন্দ্রনাথের ছোড়দিদি বর্ণকুমারী দেবী।

যাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতি তে লিখেছিলেন “……দেখিতাম ছোড়দিদি আমাদের সঙ্গে সেই একই নীলকমল পন্ডিত মহাশয়ের কাছে পড়িতেন কিন্তু পড়া করিলেও তাঁহার সম্বন্ধে যেমন বিধান, না করিলেও সেইরূপ। দশটার সময় আমরা তাড়াতাড়ি খাইয়া ইস্কুল যাইবার জন্য ভাল মানুষের মত প্রস্তুত হইতাম– তিনি বেণী দোলাইয়া দিব্য নিশ্চিন্ত মনে বাড়ির ভিতর দিকে চলিয়া যাইতেন।”

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম ১৮৫৮ সালে জোড়াসাঁকোয়। ঠাকুরবাড়ির গৌরবোজ্জ্বল সময়ে তাঁর জন্ম হলেও তার সম্পর্কে খুব কিছু জানা যায় না। হয়ত রূপে গুণে সেই আলোকদীপ্ত পরিবারে তিনি নজরকাড়ার মত কিছু ছিলেন না। একান্নবর্তী পরিবারে যে ছেলেটি বা মেয়েটি খুব বেশি উজ্জ্বল হয়না, অসামান্য পরিবারেও অনেক সময় সে আত্মসংকটে জর্জরিত হয়, বর্ণকুমারীও কি সেই সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন? জানা যায় না।

বর্ণকুমারীর বিবাহ হয়েছিল সাহিত্যিক রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছোট ভাই সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী তাঁর ছোটপিসি সম্বন্ধে বলেছেন, “তাঁর চেহারা বোনদের মতো অত সুন্দর ছিল না। পারিবারিক জীবন ও নানা কারণে তেমন সুখের হয়নি।” বিলেত ফেরত ডাক্তার সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন দীর্ঘদেহী – ছ ফুটের ওপর লম্বা।

বর্ণকুমারী দেবীর অভিনয় দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। ইন্দিরা দেবী বলেছেন, তাঁর ছেলেবেলার অভিনয়ের স্মৃতির মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এমন কর্ম আর করব না”, যার নাম বদলে পরে হয় “অলীকবাবু” সেই নাটকের অভিনয়। এর যে অভিনয়টি তাঁর স্মৃতিতে ছিল সেখানে পিসনি দাসীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বর্ণকুমারী। কী স্বাভাবিক অভিনয় করতেন বর্ণ পিসিমা।

এখনও মনে পড়ে, প্রথম দৃশ্যে তিনি দাসীদের মত মাটিতে বসে হাঁটু তুলে হাতের ওপর মাথা রেখে সকালবেলা বসে আছেন আর বাইরে থেকে গদাধর দরজা ঠেলতেই মাথা তুলে বলে উঠলেন, “দরজা ঠেলে কে ও? ওমা গদাধরবাবু যে! বড় মানুষের মোসাহেব, দশটা না বাজতেই ঘুম ভাঙলো?” এই অভিনয়ের অন্তত পঞ্চাশ বছর পরেও ইন্দিরা দেবী তা ভুলতে পারেন নি। আশ্চর্য এখানেই যে বর্ণকুমারী দেবী এরপর আর কোন অভিনয় করেছেন বলে জানা যায় না।

বর্ণকুমারী দেবীর সঙ্গে তাঁর পিত্রালয়ের সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট ভাল। যে কারণে তিনি তাঁর সম্পর্কে নাতি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলতে পেরেছিলেন তাঁকে দক্ষিণ ভারত দেখিয়ে আনতে। পিতৃগৃহের প্রতি তাঁর অন্তরের টান ছিল। তাঁর বাড়ি কেউ গেলে তিনি না খাইয়ে ছাড়তেন না। এমন কি নিজের লোকজনের কাছে টাকা রেখে নিজের প্রয়োজনেই তা ফিরে পান নি। কিন্তু তা নিয়ে কোন অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেননি। ভাই বোনদের প্রতি তাঁর টানের প্রমাণ আছে রাণী চন্দের লেখাতেও।

রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার অনুষ্ঠান হয়েছিল জোড়াসাঁকোয়। “গুরুদেবের এক দিদিই জীবিত তখন – বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে। গৌরবরণ একখানি শীর্ণ হাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন”।

দুজনে দুপাশ দিয়ে ধরে রেখেছিল বর্ণকুমারী দেবীকে – এতটাই অশক্ত তিনি তখন। ফোঁটা দেবার পর রবীন্দ্রনাথের বিছানার পাশে চেয়ারে বসে ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে বললেন, “দেখ রবি তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও”। স্বভাব রসিক কবি ছোড়দিদির সঙ্গে রসিকতা করে বললেন, “না কক্ষনও আর ছুটে ছুটে যাব না। বসে বসে যাব এবার থেকে”। বর্ণকুমারী দেবী তত বলতে লাগলেন, “না রবি যা বলছি শোন। ছুটে ছুটে আর কোথাও যাবে না তুমি”।

এই ঘটনার কিছু দিন পরেই এল শ্রাবণের সেই দিন। তার আগের রাতের বর্ণনা শোনা যাক রাণী চন্দের জবানীতে। “বর্ণকুমারী দেবী ভাইকে দেখতে এসে রাত্রে এখানেই রয়ে গেলেন। একবার করে বর্ণকুমারী দেবী কাঁপতে কাঁপতে এ ঘরে আসেন ভাইকে দেখতে – সামনে আর আসতে পারেন না, গুরুদেবের মাথার কাছ থেকেই ফিরে যান। আবার আসেন”। তারপর? কবির শেষ সময়ে কী করছিলেন তাঁর তিন বছরের বড় দিদি? জানা যায় না।

জানা যায় না আরও অনেক কিছু। তবে ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, “ছোট ভাই যে চোখের সামনে চলে গেলেন সে ধাক্কা বর্ণপিসিমার মনে খুব লেগেছিল। তিনিও আর বেশিদিন বাঁচেননি”। সে বাঁচাও খুব সুখের হয়নি। কেননা, অতি বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে তাঁর নিজের বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল। বাড়ি বিক্রির টাকা দুই ছেলেকে সমান ভাগ করে দিয়ে “শেষ জীবনে বেনেপুকুরে একটি সামান্য ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে গিয়েছেন”। এভাবেই ১৯৪৮ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন এক উজ্জ্বল অভিনেত্রী, একজন মরমী মানুষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...