ঠাকুরবাড়ির হারিয়ে যাওয়া প্রতিভা: অভিজ্ঞা দেবী

রবীন্দ্রসঙ্গীত বাঙালির সুখ দুঃখের সাথী। গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন শিল্পীরা। তাদের কণ্ঠ কানে যেমন বাজে, প্রাণেও বাজে।
কিন্তু আমরা কি জানি কত কণ্ঠ হারিয়ে গিয়েছে?‌ ঝরে গিয়েছে কত প্রতিভা?‌
এমনই এক হারিয়ে যাওয়া শিল্পী অভিজ্ঞা দেবী।
অভিজ্ঞার জন্ম ১৮৭৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা নীপময়ী দেবী ছিলেন মহর্ষির বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা। হেমেন্দ্রনাথের টান ছিল বিজ্ঞানে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে কিছুদিন পড়েছিলেন তিনি। স্কুলের ছাত্রদের জন্য বিজ্ঞানের বই লেখার ভাবনা ছিল তাঁর। শরীরচর্চায় উৎসাহী হেমেন্দ্রনাথ পরিবারে, বিশেষ করে মেয়েদের লেখাপড়া ও গানবাজনা শেখানোর দিকে নজর দিয়েছিলেন। তাঁর আগ্রহেই নীপময়ী জোড়াসাঁকোর গাইয়ে বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে গান শিখেছিলেন। শিখেছিলেন ছবি আঁকতে, এমনকি তবলা ও করতাল বাজাতে। হেমেন্দ্রনাথের কড়া শাসনের কথা জানিয়েছেন তাঁর বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী - 'তাঁর শেখাবার দিকে খুব ঝোঁক ছিল। আমরা মাথায় কাপড় দিয়ে বসতুম আর এক একবার ধমক দিলে চমকে উঠতুম'। হেমেন্দ্রনাথ ও নীপময়ীর সন্তানদের মধ্যে অভিজ্ঞা ছিলেন অনন্যা।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাঙ্গীতিক আবহে সুরের ঝর্ণাতলায় নিজেকে ভরিয়ে তুলেছিলেন অভিজ্ঞা। তাঁর মিষ্টি ও দরদি গায়নমাধুরীতে চিরমুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর মতো সঙ্গীতবোদ্ধারা। কী ছিল তাঁর গানে? ‘‌তাঁর গলার টিম্বার অদ্ভুত ছিল’‌ - বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ। প্রমথ চৌধুরীর স্মৃতিতে উজ্জল ছিল অভিজ্ঞার গাওয়া বাল্মীকি প্রতিভার গান যা এমন মর্মস্পর্শী করে আর কাউকে কখনও গাইতে শোনেননি। বাল্মীকি প্রতিভা, কালমৃগয়া আর মায়ার খেলা গীতিনাট্যে অভিজ্ঞার গান সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। শাস্ত্রীয়সঙ্গীতেও সমান দখল ছিল তাঁর। বাজাতে পারতেন এসরাজও।
‘‌ঠাড়ি রহো মেরে আখন আগে’‌-ছায়ানটে বাঁধা এই গানটিতে অভিজ্ঞার সুরমাধুর্যে প্লাবিত হয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী। বাল্মীকি প্রতিভায় অভিজ্ঞার ‘‌হা কী দশা হল আমার’‌ গানে বাঙালি দর্শক-শ্রোতা আবেগে আকুল হত। সেই স্মৃতিচারণে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‌এখনও মায়ার খেলার গান যদি কাউকে গাইতে শুনি, তার গলা ছাপিয়ে কতদূর থেকে আমাদের সেই ছোট বোনটির গান যেন শুনি’‌। কিশোরী কন্যাটিকে প্রথম দেখে প্রমথ চৌধুরীর মনে হয়েছিল যেন ‘‌অশরীরী সঙ্গীত’।
জীবন ধরে রাখতে পারেনি এই প্রতিভাময়ীকে। চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের রাতেই প্রবল জ্বর। পরে ধরা পড়ল ক্ষয়রোগ। মাত্র একটি মাসের বিবাহিত জীবন ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন অভিজ্ঞাদেবী। ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‌‘‌আজ প্রাতে সব পাখি উঠিয়াছে গাহি/শুধু মোর কন্ঠস্বর এ প্রভাত বায়ে/অনন্ত জগৎ মাঝে গিয়েছে হারায়ে’‌।ব্যক্তিগত শোক ছাপিয়ে প্রমথ চৌধুরীর মনে হয়েছিল ,'বাংলাদেশের একটি রত্নপ্রদীপ অকালে নিভে গেল।' অভিজ্ঞা দেবী আজ তাই এক হারানো সুর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...