বাংলার অন্যতম প্রাচীন জনপদ হল খড়দহ। বহুকালের খড়দহ এখন লোকমুখে খড়দা হয়েছে। নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের জন্মভূমি এবং রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য খড়দহের উল্লেখ রয়েছে বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের 'মনসা বিজয়' কাব্যেও। সেই জনপদের অন্যতম প্রাচীনতম মন্দির হল শ্যামসুন্দর মন্দির। বৈশাখী পূর্ণিমায় ফুলদোল উৎসব, কার্তিক পূর্ণিমার রাসযাত্রা, মাঘী পূর্ণিমায় বার্ষিক উৎসব, ফাল্গুনী পূর্ণিমায় দোলযাত্রাসহ নানান উৎসব-অনুষ্ঠান ভাণ্ডারায় শ্যামসুন্দরের মন্দিরে সারা বছর ধরে জনসমাগম হয়। বাংলাজুড়ে অজস্র মানুষ এখানে আসেন, দূরদূরান্ত থেকে ভক্তের ঢল নামে। গঙ্গার পূর্ব তীরে শ্রীপাট খড়দহের কথা বহুল প্রচলিত এবং সেই সঙ্গেই বহুল চর্চিত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় 'দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী, কালীঘাটের কালী, আর খড়দার শ্যামসুন্দর; এঁরা জীবন্ত, হেঁটে চলে বেড়ান, কথ কন, ভক্তের কাছে খেতে চান'। আজও গঙ্গা মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে।
অসংখ্য জনশ্রুতির রয়েছে এই মন্দিরকে ঘিরে। শোনা যায়, নিত্যানন্দর ছেলে বীরভদ্র গোস্বামী শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, গঙ্গার পশ্চিম তীরের বল্লভপুর গ্রামের রুদ্র ব্রহ্মচারী স্বপ্নাদেশ পান। স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে গৌড়ের বাদশাহের প্রাসাদ থেকে পাথর এনে তা দিয়ে বিগ্রহ তৈরি করতে বলেন। রুদ্র গৌড়ে গিয়ে বাদশাহের কাছে ওই স্বপ্নের কথা জানিয়ে পাথর চান। কিন্তু বাদশাহ রাজি হননি। এরপরেই ঘটে আশ্চর্য ঘটনা। পাথরের গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। জনৈক এক মন্ত্রী বাদশাহকে বলেন, এ অশুভ লক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গেই ওই পাথর রুদ্রকেমদিয়ে দেওয়া হয়। সেই ভারী পাথর নৌকায় তুলতে গিয়ে জলে পড়ে যায়। কিন্তু দৈব প্রভাবে পাথরটি শ্রীরামপুরের কাছে রুদ্রের বসতবাড়ি বল্লভপুরের ঘাটে ভেসে চলে আসে। এই পাথর থেকে শ্যামসুন্দর, রাধাবল্লভ ও নন্দদুলালের তিনটি বিগ্রহ তৈরি হয়।
বীরভদ্র শ্যামসুন্দরের বিগ্রহটি চান, কিন্তু রুদ্র দিতে রাজ হননি। প্রসঙ্গত, শ্রীগৌরাঙ্গের অন্যতম প্রধান পার্ষদ, শ্রীনিত্যানন্দের অষ্টম পুত্র ছিলেন বীরভদ্র গোস্বামী। এরও বহুকাল পরের কথা, রুদ্রর পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পণ্ড হতে বসলে, বীরভদ্র তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে বর্ষা রুখে দেন শ্রাদ্ধমণ্ডপ রক্ষা পায়। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে রুদ্র বীরভদ্রকে শ্যামসুন্দর বিগ্রহ দান করেন। বীরভদ্র প্রথমে কুঞ্জবাটীতে শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে সেখানেই একটি ছোট্ট মন্দির নির্মাণ করেন। কালের নিয়মে সে মন্দির আর নেই। আনুমানিক প্রায় দুশো বছর আগে খড়দহের জনৈকা পটেশ্বরী গোস্বামী নামে এক ধর্মপ্রাণ গৃহবধূ আজকের শ্যামসুন্দর মন্দিরটি নির্মাণ করেন। সেখানেই শ্যামসুন্দরের রাধামনোহারী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শ্রীপাট খড়দার খ্যাতির অন্যতম প্রধান কারণ হল শ্রীশ্রীরাধা-শ্যামসুন্দর জীউয়ের মন্দির। শ্রীরাধা-শ্যামসুন্দর জীউয়ের মন্দির স্থানীয়দের মুখে হয়ে গিয়েছে 'শ্যামের বাড়ি'। শ্রীশ্যামসুন্দরের মন্দিরের নিকটে রয়েছে কুঞ্জবাটী। সমগ্র বাংলায় মহাপ্রভুর হরিনাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যাকে বিবাহ করেন নিত্যানন্দ। তারপর কুঞ্জবাটীতেই গড়ে তোলেন নিজেদের সংসার। সেখানেই বীরভদ্র গোস্বামীর জন্ম।
কথিত রয়েছে, চৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ অপ্রকট হওয়ার পর বীরভদ্র দৈবাদেশ পান, মালদহের নবাবের রাজপ্রাসাদের তোরণে একটি কালো পাথর রয়েছে। সেই পাথর থেকে কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি করিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিংবদন্তি অনুসারে, ওই পাথরটিকে রাজা পরীক্ষিৎ ওই তোরণে স্থাপন করেছিলেন। তারপর যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে শ্রীকৃষ্ণ ওই পাথরটির উপর দাঁড়িয়ে যজ্ঞে আগত ব্রাহ্মণদের পা ধুইয়ে দেন। বীরভদ্র সপার্ষদ নামসঙ্কীর্তন করতে করতে হাজির হলেন তখনকার মালদহে, তখনকার গৌড়ের নবাব সোলেমান খাঁয়ের দরবারে। মালদহের নবাব সংবাদ পেয়ে বীরভদ্রকে বন্দি করলেন এবং ষড়যন্ত্র করলেন, গোমাংস খাইয়ে বীরভদ্রের ধর্ম নষ্ট করবেন। সেই উদ্দেশ্যে রাজসভায় বীরভদ্রের জন্যে ঢাকা দেওয়া একটি খাবারের থালা আনা হয়। ঢাকনা সরানো হলে দেখা গেল, গোমাংসের বদলে থালায় রয়েছে পুষ্পমাল্য। নবাব দমলেন না। সুরার পাত্র আনিয়ে বীরভদ্রকে পান করতে বললেন। এবারেও দেখা যায়, সুরার বদলে পাত্রে রয়েছে দুধ। কাণ্ড দেখে নবাব ভয় পেলেন। তিনি বীরভদ্রের কাছে ক্ষমা চাইলেন। অনুরোধ করলেন, বীরভদ্র যদি তাঁর দৈব ক্ষমতার সাহায্যে নবাবের অসুস্থ জামাইকে সুস্থ করে তোলেন। বীরভদ্র শর্ত দেন, জামাইয়ের সুস্থ শরীরের বিনিময়ে তিনি রাজপ্রাসাদের তোরণে রক্ষিত বিশেষ কষ্টিপাথরটি নিয়ে নেবেন। নবাব রাজি হলেন। বীরভদ্রের নির্দেশে সুরার পাত্রের দুধ জামাইকে পান করানো হল। নবাবের জামাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করেই আকাশজুড়ে তীব্র বিদ্যুতের ঝলক, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বজ্রপাত। বজ্রাঘাতে তোরণ থেকে বিরাট এক কষ্টিপাথরের খণ্ড খুলে পড়ল।
তোরণের কষ্টিপাথরটি কীভাবে মালদহ থেকে খড়দহে এল, সে সম্পর্কেও জনশ্রুতি ছড়াছড়ি, বীরভদ্র কষ্টিপাথরটি ভাল করে খড়ে বেঁধে মালদহের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'প্রভু, তুমি খড়দহে যাও!' আবার কারও মতে, বীরভদ্র গোস্বামী বাঁশের মাচায় খড়ে মুড়ে পাথরটি জলপথে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। পাথরটি জলে ভাসতে ভাসতে গঙ্গাতীরবর্তী আকনার এক স্নানঘাটে এসে আটকায়। স্নানরত বালকের দল পাথরটিকে ঠেলে দিতেই, পাথর ভাসতে ভাসতে খড়দায় এসে পৌঁছয়। এই ঘাটের নামই শ্যামসুন্দর ঘাট। বীরভদ্র খড়দহে পৌঁছে পাথরটিকে উদ্ধার করেন এবং ভাস্করকে ধ্যানে দেখতে পাওয়া কৃষ্ণ বিগ্রহের বিবরণ দিয়ে মূর্তি গড়তে বলেন। ওই কষ্টিপাথর থেকে তিনটি কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি হয়। এই তিন বিগ্রহের মধ্যে বীরভদ্র ধ্যানে দেখা সত্য, শিব ও সুন্দরের প্রকাশ দেখেন শ্যামসুন্দর বিগ্রহে। অন্য দুই বিগ্রহের একটি পাঠানো হয় আকনায় রুদ্র পণ্ডিতের কাছে। পণ্ডিত বিগ্রহকে বল্লভ জীউ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। দেবতার নামে আকনার নতুন নাম হয় বল্লভপুর। বীরভদ্র তৃতীয় বিগ্রহের নাম রাখেন 'নন্দদুলাল'। নন্দদুলালকে বীরভদ্র পাঠান স্বামীবনে সাঁইবোনা লক্ষণ পণ্ডিতের কাছে।
৯৭৭ বঙ্গাব্দের মাঘী পূর্ণিমায় অদ্বৈত আচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র অচ্যুতানন্দ গোস্বামী শ্যামসুন্দরকে কুঞ্জবাটীতে প্রতিষ্ঠা করেন। পরে নিত্যানন্দের সহধর্মিণী জাহ্নবা দেবীর ইচ্ছেয় শ্রীশ্যামসুন্দরের বামে অষ্টধাতুর রাধিকা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে কুঞ্জবাটীতে বিগ্রহসেবার যথেষ্ট জায়গার অভাব দেখা দিলে চারশো বছরেরও বেশি আগে নির্মিত হয় বর্তমান শ্যামসুন্দর মন্দির। বর্তমানে কুঞ্জবাটীতে নিতাই-গৌর এবং বীরভদ্র গোস্বামী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহই বিদ্যমান। ওই পাথর থেকে তৈরি তিন কৃষ্ণমূর্তিতে শ্রীকৃষ্ণের তিন রকম রূপ প্রকাশ পেয়েছে। বল্লভ জীউ বিগ্রহে তিনি রাধারানির প্রেমাস্পদ, নন্দদুলাল বিগ্রহে প্রকাশ পেয়েছে গোপালসুলভ বাৎসল্য এবং শ্যামসুন্দর বিগ্রহে স্বয়ং পরমেশ্বর বিরাজমান।
শ্যামসুন্দর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অভিনব। গৌড়ীয় ঢঙে নির্মিত। মন্দিরটি পালকির মতো দেখতে। গর্ভগৃহে রুপোর সিংহাসনে অষ্টধাতুর শ্রীমতী ও শিলাময় অনন্তদেবের সঙ্গেই রয়েছেন শ্রীশ্যামসুন্দর। তাঁর হাতে মুরলী। প্রসন্ন গম্ভীর শান্ত মুখ, আয়ত চোখ। বিশাল আটচালা পূর্বমুখী মন্দিরে কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মন্দিরের সামনেই নাটমন্দির, গর্ভমন্দিরে অলঙ্কৃত রূপোর সিংহাসনের উপরে শ্রীশ্যামসুন্দরের অধিষ্ঠান। একরাশ ঝাঁকড়া কালো চুলে ভরা মাথা। টানা টানা ফালা ফালা চোখ দুটো যেন একটা পটলের দুটো ফালি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনা-রূপার নানা অলঙ্কারের ছড়াছড়ি। কেয়ূরে কুণ্ডলে কঙ্কণে অপূর্ব শোভা। মাথায় সুসজ্জিত ময়ূরপুচ্ছের মুকুট। হাতে অপ্রাকৃত রাধাপ্রেমের রাধানামের উজানভরা মোহন বাঁশি। সঙ্গে বৃন্দবনি আদলে দাঁড়ানো বৃষভানুনন্দিনী রাধার অষ্টধাতুর বিগ্রহ। এক ঢাল এলোচুল নেমে গিয়েছে পিঠ ছাড়িয়ে। শ্যামকে পেয়ে মুখে হাসি যেন আর ধরছে না। বসনে–ভূষণে যেন সেকালের জমিদার বাড়ির গিন্নি। এখানেই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পূজিত হন দশমহাবিদ্যার তৃতীয় মহাবিদ্যা ত্রিপুরাসুন্দরী এবং নীলকণ্ঠ শিব। নিত্যানন্দ কুঞ্জবাটীতে দুর্গাপুজোরও প্রচলন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকাকে কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে বৃন্দাবনে কালী রূপ ধারণ করেছিলেন। তাই দীপান্বিতা অমাবস্যায় শ্যামকে 'শ্যামা'রূপে আরাধনা করা হয়। দোল এবং রাস উৎসবে খড়দহ যেন গুপ্ত বৃন্দাবন। বছরের এই দুদিন বিগ্রহকে চতুর্দোলায় চাপিয়ে দোলমঞ্চ ও রাসমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। রাসের শেষ দিনে মন্দিরে 'খিচুড়ি লুট' উৎসব হয়। শ্রীরাধা-শ্যামকে নিবেদিত খিচুড়ি ভক্তেরা লুট করে নিয়ে যান।
কুঞ্জবাটী রইল ডানদিকে, বাঁদিকেই শ্যামসুন্দর মন্দিরের পথ। একটু এগোলেই প্রথমে বামদিকে পড়ে মদনমোহন মন্দির। পশ্চিমমুখী আটচালা মন্দিরে পদ্মের উপরে দাঁড়ানো শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ কষ্টিপাথরের, শ্রীরাধিকার বিগ্রহ অষ্টধাতু নির্মিত। গর্ভমন্দিরের বেদিতে রয়েছেন শালগ্রামশিলাসহ গোপাল। মদনমোহন মন্দির ছেড়ে এগোলেই ডান পাশে শ্যামসুন্দরের রান্নাঘর। এখানেই ভোগ রান্না হয়।
প্রতিদিন ভোরে শ্যামসুন্দরের মঙ্গলারতি, বাল্যভোগ, স্নান ও বস্ত্র পরিবর্তন হয়। কম করে দশ-বারো রকমের ভোগ নিবেদিত হয় দুপুরে। নৈবেদ্যে থাকে অন্ন, ঘি-ভাত, পোলাও, শাক বা অন্য কোন ভাজা, শাক চচ্চড়ি, মোচার ঘণ্ট, শুক্তো, ধোঁকার ডালনা, ডাল, ডালের ঘণ্ট, পনির, পায়েস, মালপোয়া, চাটনি। নিত্য রান্নাভোগ দেওয়া হয়, কোন ভক্তের দেওয়া ভাণ্ডারা থাকলে ভোগের উপকরণ আরও বাড়ে। রাতে সন্ধ্যারতি, সেবা, শীতল ভোগ দিয়ে বন্ধ হয় মন্দিরের দরজা। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এই মন্দিরের ভোগ হিসেবেই নাকি রাধাবল্লভীর জন্ম হয়েছিল। এমন মনোহর চোখের শ্যাম এ বাংলায় আর রয়েছে বলে মনে হয় না। এই মন্দিরে ধর্মীয় মেলবন্ধন তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত ধর্মের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছে শ্যামসুন্দর মন্দির।