"আব্বা কোথায় মা?", আব্বার সঙ্গে কেন দেখা হয় না?" ছোট্ট বিবির প্রশ্নে জর্জরিত মা মুস্তারী। মেয়ে বারবার বাবাকে খোঁজে। পিতা ও আত্মীয় পরিজন হীন জীবন খুব একটা সহজ ছিল না সেই ছোট্ট মেয়েটির কাছে। জীবন বারবার ধাক্কা দিয়েছে তাঁকে। তবে সেই ছোট্ট বিবি হার মানেননি। জীবন তাকে দগ্ধ করলেও জীবনকে হারিয়ে দিয়েছেন বারবার। নিজের তৈরি করা পথেই এগিয়েছেন। কিন্তু একটা সুগম পথ তৈরি করতে কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছিল তাঁকে।
একটা ছোট্ট মেশিনারি স্কুলে পড়তো বিবি। একদিন সেই স্কুলে ভারী ব্যস্ততা। সেইদিন সেই স্কুলে আসার কথা ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল গওহরজানের। গওহরজানের গানে তখন মুগ্ধ আসমুদ্র হিমাচল। এমন মানুষ স্কুলে আসবে শুনেই বিবির ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়েছে। যথারীতি সময়মতো এলেন গওহরজান।
স্কুলের এক শিক্ষিকার সঙ্গে ক্লাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎই গায়িকার ওড়নায় ছোট্ট হাতের টান পড়ল। একটা মিষ্টি মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি।
যথারীতি গওহরজান জিজ্ঞেস করলেন মেয়েটিকে, “কী নাম তোমার?”। “কী দেখছ তুমি?”। মধুমাখা সবরে সেই মেয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার নাম ‘বিবি’’। এইটুকু কথার গলার আওয়াজেই মুগ্ধ গওহরজান। এত ছোড়ড় বয়সে এমন সুরেলা আওয়াজ! গান না শিলে তো কিছুতেই সম্ভব নয়!
গওহরজান জিজ্ঞেস করলেন বিবিকে "তুমি নিশ্চয়ই গান জানো, এমন মিষ্টি গলার আওয়াজ গান না শিখলে কিছুতেই সম্ভব নয়। তা একটা গান গাও না।" ছোট বিবি অবাক। টুকটাক গান গুনগুন করা ছাড়া কোন তালিম তার নেই। সেই সামর্থ্যও নেই! এদিকে ইনভিজিলেটারের আবদার অস্বীকার করার উপায় নেই।
অগত্যা গান গাইল বিবি। দু কোটিখানি মুগ্ধ ডান্সিং গার্ল। দুহাত তুলে আশীর্বাদ করেছিলেন তিনি বিবিকে। এই মেয়ের গানে মুগ্ধ হবে বিশ্ব।
তখনও পর্যন্ত তথাকথিত প্রথাগত গানের শিক্ষা বিবির ছিল না। তবে জীবনের গতিপথ বদলে যায় তাড়াতাড়ি। ডান্সিং গার্ল এর উৎসাহে ছোট বিবি বাড়ি গিয়ে মায়ের আঁচল টেনে ধরল। বাবা নেই তার, দিদি সেই কবে মারা গেছে। জীবন বলতে শুধুই লড়াই। গানের প্রতি ভালোবাসা, প্রেম ছিল। তবে চর্চার অভাবে সে নিয়ে কাজ করা হয়নি। মায়ের কাছে বিবি আবদার করলো গান শিখবে ওস্তাদ ইমদাদ খাঁর কাছে। নাড়া বাধা শুরু হল।
মাত্র 9 বছর বয়সে রেকর্ড করল বিবি। সেই তখন আখতারি বাই ফইজাবাদী। গানের সঙ্গে ভালোবাসা আর জীবনের সঙ্গে লড়াই শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। সাধনায় মগ্ন হয়েছিল সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা। আখতারী বাই ফইজাবাদি হয়ে উঠেছিলেন বেগম আখতার।
বেগম আখতার মালিকা-ই-গজল। গজল সম্রাজ্ঞী তিনি। তানপুরা হাতে নিলে ডুবে যান সাধনার সাগরে। অন্তরের মন্থনে তখন জীবনের কষ্ট বিষ রূপে উঠে আসে। সুর দিয়ে তা পান করেন তিনি। কঠিন যন্ত্রণা বদলে যায় অমৃতে। সাধনা তীব্র হয়। এভাবেই বেগম আক্তার সমস্ত অন্ধকার গায়ে মেখে আলোর প্রতিরূপ হয়ে উঠে দাঁড়ান। তিনি নিজেকে বারবার দগ্ধ করেছেন ভেঙেছেন। প্রয়োজনে আবার ছাই ভস্ম মেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন গড়ে নিয়েছেন। জীবনের সুরে তার গলা গেয়ে উঠেছে। জীবন পথে সব থেকেছেন তিনি।
নিজের প্রথম রেকর্ড বেরোনোর পর সেভাবে তা চলেনি। মা মুস্তারি ভেঙে পড়েছিলেন তখন। তবে কি লড়াইয়ের শেষে সবটাই অন্ধকার? আছিতো স্বামী নতুন সংসার করে ফিরেও তাকাননি মা আর মেয়ের দিকে। সুরের জগতে মেয়ের এই পদার্পণ আশার আলো দেখিয়েছিল মাকে। তবে কি সেই আশা ও মিথ্যে হয়ে যাবে?
এক পীর বাবার কাছে নিয়ে এসেছিলেন মেয়েকে। ছোট্ট আখতারী বাই ফইজাবাদী কে দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন এই মেয়ের ভবিষ্যৎ কি? শিল্পীর বাবা আশ্বস্ত করেছিলেন আখতারী বাইকে। তার মাকে বলেছিলেন "এই মেয়ের সামনে একদিন সারা পৃথিবী নতজানু হবে।" গানের মধ্যে দিয়ে সে ঈশ্বরের দর্শন পাবে।
বেগম আখতার ১৩ বছর বয়সে গান গেয়েছিলেন "দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো"। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। গানের জগৎ থেকে থিয়েটারেও নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। যথারীতি অভিনয়ও নিজের জাদু দেখিয়েছিলেন। মুম্বাই থেকে ডাক পেয়েছিলেন অভিনয়ের জন্য। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আবার একটা অন্ধকার গ্রাস করছিল আখতারি বাঈকে। বুঝতে পারছিলেন অভিনয়ে ঠিক অন্তরাত্মা সুখী হচ্ছে না। তাই আবার ফিরে আসেন সংগীতের কাছে।
হজ যাত্রা করেছিলেন তিনবার। গানই ছিল তাঁর আরাধ্য ঈশ্বর। সাধনা করেছেন অন্তর থেকে। অজসো ছাত্র ছাত্রী তার সুরের স্পর্শে ধন্য হয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে সকল ধর্মের সমান আদর করেছেন তিনি। সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন আজীবন। সুর তাকে কোনদিন নিঃসঙ্গ হতে দেয়নি। বারবার বলতেন যদি কৃতকার্য হতে চাও তবে একা থাকো। ভারতের সনাতন ঐতিহ্য তার জীবনে তার মনে দীর্ঘস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল। এক বিশাল সুরের বৃক্ষের মতো ছিলেন তিনি। যার চরণে মাথা নত হয়েছে বারবার।
নিজের গর্ভে মৃত্যু সন্তান বেড়ে ওঠা সহ্য করেছেন তিনি। সন্তান শোকে কখনো অন্তরাত্মা কেঁদেছে। মৃত্যুর কথা ভেবেছেন। কিন্তু সেই অন্ধকার থেকেও তাকে উঠে দাঁড় করিয়েছে সংগীত নামের ঈশ্বর। আখতারিবাঈ এর বিকম আক্তার হয়ে ওঠার পথে যেমন অজস্র কাঁটা তাঁকে কষ্ট দিয়েছে তেমনভাবেই সংগীত ছায়ার মত করে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে।