সিংহলের একটি ভিক্ষুণী-সংঘ। এক নারী উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন এখানে। এই সময় সম্রাট অশোক ছিলেন রাজা। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত এক সাধক তিনি তখন। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করছেন তিনি। তাঁর কানে এসেছে সিংহলের সেই ভিক্ষুণী-সংঘের কথা। এক ত্যাগী নারী সেখানে সকল কাজকর্ম করেন। ইচ্ছুক মহিলাদের দীক্ষা দেন। দূর থেকে সেই নারীর কথা শুনে অশোকের চোখ ছলছল। তাঁর হৃদয় কাঁদে। মেয়ের মুখ ভাসে।
এই সময় তাঁর মানসপটে ভেসে ওঠে এক স্মৃতিচিহ্ন। তখন অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন সবেমাত্র। সেই সময় তিনি তাঁর দুই সন্তানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষুক ও ভিক্ষুণী হওয়ার কথা। তাঁর প্রথম সন্তান ছিলেন এক পুত্র, দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন এক কন্যা।
পিতা অশোক জানতেন তাঁর পুত্র কখনোই বাবার কথা অমান্য করবে না। কন্যাও বাধ্য, তাঁর সহবত জ্ঞান যথেষ্ট। কিন্তু সেই কন্যা তখন বিবাহিতা। একটি পুত্র রয়েছে তাঁর। এক রাজার স্ত্রী তিনি। পারিবারিক, সাংসারিক জীবন ছেড়ে কন্যা কি ধর্মপথে পা বাড়াবেন? সংশয় ছিল অশোকের। তাই কন্যাকে জিজ্ঞেস করার আগে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন অশোক। তারপর যখন জিজ্ঞেস করলেন যে তাঁর কন্যা বৌদ্ধ ভিক্ষুণী হওয়ার পথে পা বাড়াতে চায় কিনা, বাবাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সেই কন্যা জবাব দিয়েছিলেন "নিশ্চয়ই চাই, আমি যে কোন মুহূর্তে আমার প্রাচুর্যে ভরা জীবন ত্যাগ দিতে প্রস্তুত।" অবাক হয়েছিলেন অশোক।
তাঁর কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে একটি বৌদ্ধ ভিক্ষুণী-সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এই সংঘের কাজের কথা মুগ্ধ করেছিল অশোককে। পরবর্তীকালে নিজের কন্যার জন্য গর্ববোধ করতেন অশোক।
গোয়ালিয়র রাজ্যের অন্তর্গত ভিলসা নামে যে স্থান অশোকের স্তুপ-এর জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলের প্রাক্তন নাম ছিল বিদিশা। এই অঞ্চলেরই রাজকন্যা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন সম্রাট অশোক। এই দেবীর প্রথম পুত্র ছিলেন মহেন্দ্র। মহেন্দ্র জন্মের পর দু’বছর বাদে একটি কন্যা সন্তান জন্ম দেন দেবী। তার নাম সঙ্ঘমিত্রা। অশোকের আত্মজা।
বিয়ের পর দীর্ঘদিন সংঘমিত্রার মা পিত্রালয়ে ছিলেন। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে অশোক যখন পাটুলিপুত্রে ফিরে আসেন, তাঁর সঙ্গী হয়েছিল পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা। সংঘমিত্রার তখন বয়স ১২ বছর।
যথাসময়েই সম্রাট অশোক তাঁর কন্যা সংঘমিত্রার বিয়ে দিয়েছিলেন ভাগ্নে অগ্নিব্রহ্মার সঙ্গে। বিয়ের পর সংঘমিত্রা ও অগ্নির একটি পুত্র হয়। এই পুত্রের নাম সুমন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলেন। ভোগ-বিলাসের থেকে ত্যাগের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রবল। তিনি যৌব-রাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন তাঁর ভাই তিস্যকে।
কিন্তু তিনিও পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর একে একে অশোকের পুত্র এবং কন্যা বৌদ্ধ ধর্মের সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেন।
বৌদ্ধ-ভিক্ষুণী হওয়ার পর সঙ্ঘমিত্রাও বেশ কিছুদিন পাটলীপুত্রে বসবাস করেছিলেন। ধর্মপালা নামের এক আচার্য্যা তাঁকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। রক্তাম্বর রঙের পোশাক পরে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবন ধারণ করতেন সংঘমিত্রা।
বৌদ্ধ ধর্মের জন্য স্বামী-সন্তানের দিকে তাকাননি। রাজ সম্পত্তি উপেক্ষা করে চলে এসেছিলেন। তবে এর জন্য তাঁর পরিবারের মানুষজন তাকে কখনোই দূরে সরিয়ে দেননি।
পাটলিপুত্রে বেশ কিছুদিন থাকার পর সিংহলে চলে যান সংঘমিত্রা। সেখানেই কাটিয়েছিলেন বাকি জীবন। ত্যাগের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি পরিচিত সকলের কাছে। বাবা ছিলেন সম্রাট, স্বামীও ছিলেন রাজা। তবুও কোনদিন কোন সম্পত্তির দিকে ফিরে তাকাননি।
ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে বৌদ্ধবিহারে দিন কাটিয়েছেন। জীবনের কোন ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেননি। যে সুখ, যে মোহ পার্থিব চিন্তায় মনকে আচ্ছন্ন করে, তা সর্বদা ত্যাগ করেছেন এই নারী। তাই বৌদ্ধ যুগের ইতিহাসে সংঘমিত্রার নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত।