প্রাচীন ভারতের নারীরা সবসময়ই ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। কখনও জীবনকেও আশ্চর্য করেছেন। তাঁরা দুঃখ পেলেও জীবন থেকে মুখ ফেরাননি। বরং সেই দুঃখের জীবনকেই আগলে রেখে লড়াই করেছেন। তেমনই এক নারী রাজ্যশ্রী। শৈশব ও কৈশোর তাঁর কেটেছিল ঐশ্বর্যের ভেলায় চড়ে। বাবার একমাত্র কন্যা-সন্তান ও দুই আদরের দাদার একমাত্র স্নেহাস্পদ বোন রাজ্যশ্রী।
এই রাজকন্যাকেই ভাগ্য তার কষাঘাতে যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছে। কখনো তাঁর জীবনসংশয় তৈরি হয়েছে। তবুও তিনি জীবন থেকে মুখ ফেরাননি। মরুভূমির মতো জীবনযাপন করলেও জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারাননি।
বানভট্ট অচেনা পর্যটক হিউয়েন সাং তাঁদের রচিত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন রাজ্যশ্রীর কথা। তাঁর জীবনের কথা।
রাজ্যশ্রীর বাবা ছিলেন থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশের মহারাজ প্রভাকরবর্ধন। প্রভাকরবর্ধন ছিলেন অত্যন্ত স্নেহশীল ও দয়াশীল রাজা। তাঁকে মহারাজাধিরাজ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। পরাক্রমশালী এই রাজা তাঁর ক্ষমতায় আশেপাশের ছোট রাজ্যগুলিকে জয় করে সেগুলিকে নিজের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। ফলে তাঁর রাজ্যকে অনেক ঐতিহাসিকই সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করেন।
রাজ্যশ্রীর জন্মের সময় তাঁর বড় ভাই রাজ্যবর্ধনের বয়স ছিল ছ'বছর এবং ছোট ভাই হর্ষবর্ধনের বয়স ছিল তিন বছর। বাবা-মা ও ভাইদের স্নেহে বড় হন তিনি। ঐশ্বর্যের কোন অভাব নেই।
ছোট থেকেই রাজকন্যা রাজ্যশ্রী বুদ্ধিমতী ও সুন্দরী ছিলেন। শোনা যায় রাজার নাকি নিজের কন্যার প্রতি স্নেহ এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি কন্যার বিবাহ দিতে চাননি। একদিন রাজপ্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি শুনতে পান রাজ্যে এই নিয়ে কানাকানি শুরু হয়েছে। এমনকী রাজকন্যার বিবাহ না হওয়া নিয়ে গানও বাঁধা হয়েছে।
রাজা তখন নিজের মত বদলান। পাশের নিবাসী রাজ্যের রাজপুত্র গ্রহবর্মার সঙ্গে বিয়ে দেন রাজ্যশ্রী। এদিকে প্রভাকরবর্ধনের নিজের পাশের নিবাসী রাজ্যের মধ্যেও শুরু হয়েছে বিরোধ।
বিয়ের পর রাজকন্যা কনৌজে স্বামীর কাছে চলে যান। এরপরই রাজ্য নেমে আসে আঁধার। রাজা প্রভাকরবর্ধন সৈন্য-সামন্ত সমেত রাজ্যবর্ধনকে পাঠান উত্তরের দিকে হুনদের আক্রমণ করতে। রাজকুমার হর্ষবর্ধনও নিজের ভাইকে সঙ্গ দেন খানিকটা পথ। কিছুদূর যাওয়ার পর হর্ষবর্ধন মৃগয়ায় চলে যান। রাজ্যবর্ধন যাত্রা করেন হুনদের ধ্বংস করার উদ্দেশে।
এদিকে রাজ্যে সে সময় অঘটন ঘটে। রাজা প্রভাকরবর্ধন প্রাণত্যাগ করেন। হর্ষবর্ধন ফিরে আসেন নিজের রাজ্য থানেশ্বরে। কিন্তু এসে জানতে পারেন তাঁর বড় ভাই এখনও ফেরেননি। শোকে তিনি উতলা হয়ে পড়েন।
নিজের বোনকে এমন দুঃখের কথা জানাতে চাননি হর্ষবর্ধন। কিন্তু হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তিনি জানতে পারেন রাজা প্রভাকরবর্ধন যখন মারা যান সেদিনই মালবের রাজা মহারাজ গ্রহবর্মাকে নিহত করে মহারানী রাজ্যশ্রীকে কারাগারে আটকে রেখেছেন। এমনকী গ্রহবর্মার রাজ্যেও আক্রমণ করেছেন এই মালবের রাজা।
হর্ষবর্ধন ক্রোধান্বিত হয়ে আক্রমণ করতে ছুটে যান সেই রাজাকে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন নিজের রাজ্যে। এই সময় গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের সঙ্গেও যুদ্ধ হয় হর্ষবর্ধনের। নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করেছিলেন হর্ষবর্ধন।
যুদ্ধ শেষে আবার ফিরে আসেন নিজের রাজ্যে। প্রাণের থেকে প্রিয় বোনের কোন খবর তিনি পাননি দীর্ঘদিন, মনোঃকষ্টে দিন কাটতে থাকে তাঁর।
অবশেষে তিনি জানতে পারেন গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক যখন কনৌজ দখল করেছিল তখন রাজ্যশ্রী সংসার, পরিবার ত্যাগ করে বিন্ধ্য পর্বতের দিকে চলে যান।
এখানে তিনি সাধিকার জীবন-যাপন করতে থাকেন। হর্ষবর্ধন ফিরিয়ে আনেন তাঁকে। নিজের রাজ্যে ফেরার পর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করা হয় তাঁকে। কিন্তু সাধিকার জীবন থেকে বেরোতে পারছিলেন না রাজ্যশ্রী।
সেই সময় রাজ্যে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হতে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর্থিক সমস্যা সবকিছুতেই জর্জরিত হয়ে পড়ে থানেশ্বর রাজ্য। রাজ্যশ্রীর ভাই তখন সাহায্য চান রাজশ্রীর। আবার জীবনে ফেরেন রাজকন্যা। রাজ্যের শাসন পরিচালনার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। নানান কল্যাণকর কাজে তিনি সাহায্য করেছিলেন তাঁর দুই ভাইকে। তবে রাজ ঐশ্বর্যের দিকে কখনও আর ফিরে তাকাননি। অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। এই বুদ্ধিমতী, সাহসী, ত্যাগী সাধিকা শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের কল্যাণকর কাজেই নিজের জীবন অতিবাহিত করেছেন।