এক সাধিকা নারীর কথা-সুজাতা

কিছু নারী তাঁর নিজের মহিমা ও সাধারণত্বের জেরেই অসাধারণ হয়ে ওঠেন। তাঁরা ইতিহাসের পাতায় যেমন স্থান দখল করেন, তা আসলে তাঁর নিজের আকাশের মত। যে আকাশকে সেই নারী অন্তর দিয়ে রক্ষা করেন, তাঁর নিজের গণ্ডিকে সেই নারী উজ্জ্বল করেন নিজের মহিমায়। তেমনই এক নারী ছিলেন সুজাতা।

বৌদ্ধ যুগের ইতিহাসে সুজাতার নাম মূলত বুদ্ধের উপাসিকা হিসেবেই পাওয়া যায়। কিন্তু সুজাতা গুণবতী ছিলেন, সাধারণ হয়েও অসাধারনত্বের গণ্ডি পার করেছিলেন।

12042683_1508436786134395_2393899926405264534_n

বৌদ্ধ যুগের ইতিহাসে সুজাতার নাম মায়ার মত। যে মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছিল গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ব লাভ।

বিহারের নীলাঞ্জনা নদীর তীরে বুদ্ধগয়ার কাছে উরুবেলা গ্রামে থাকতেন সেনানী নামে একজন ভূস্বামী। তাঁর সুজাতা নামের এক কন্যা ছিল।

বালিকা সুজাতার ছোট থেকেই সাধনার প্রতি আগ্রহী ছিল। নিজের সাধনা, ঈশ্বর আরাধনা নিয়েই মগ্ন থাকতেন সুজাতা।

উরুবেলা গ্রামে এক বিশাল অশ্বত্থ গাছ ছিল।  সেই গাছের বয়স বা তার বৃদ্ধি, ধ্বংস সম্বন্ধে কোন তথ্যই ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এই গাছটিকে এক প্রকার ঈশ্বর রূপে পুজো করতো সুজাতা।

সুজাতা আসলে বনস্পতির মতো জীবন চেয়েছিল। যে জীবন ঝড়ে ভেঙে যায় না, যে জীবন সহজে মাথা নোয়ায়না। সুজাতা একবার নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যদি সমান মর্যাদার কাউকে তিনি বিয়ে করেন আর তাঁর নিজের কোলে যদি সর্বপ্রথম একটি পুত্র-সন্তান আসে তাহলে তিনি নিজের হাতে পরমান্ন রান্না করে সেই গাছ-দেবতাকে পুজো করবেন।

সুজাতা নিজের প্রতিজ্ঞা ভোলেন নি। বিয়ের পর তাঁর পুত্র সন্তান হয়। একেবারে মেয়ে-বেলায় করা প্রতিজ্ঞা সুজাতা ভোলেননি একেবারেই। তিনি স্থির করেন এই গাছ-দেবতাকে পরমান্ন রান্না করে পুজো দেবেন।

পরমান্ন রান্না করতে গরুর বিশেষ দুধের প্রয়োজন হতো। এদিকে সুজাতা কিছুতেই দুধ আনতে পারছেন না। স্বামীও এই ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়।

"ছেলেবেলায় করা প্রতিজ্ঞা ও আর মনে রেখে কাজ নেই।" সকলেই উপেক্ষা করেছিল সুজাতাকে। কিন্তু সুজাতা ছেড়ে দেননি হাল। নিজের উদ্যোগে প্রায় এক হাজার গরুকে পালন করেছিলেন দীর্ঘদিন। সেই দুধ দিয়ে তিনি পাঁচশ গরুর জন্য বিশেষ খাবার প্রস্তুত করেছিলেন। এই পাঁচশ গরুর দুধ খাইয়েছিলেন আড়াইশো গরুকে। এই আড়াইশো গরুর দুধ খাওয়ান দেড়শ গরুকে, এমন করে তিনি মোট আটটি গরুকে শেষ পর্যন্ত দুধ খাইয়েছিলেন। তারপর সেই আটটি গরুর দুধ থেকে তৈরি করেন বিশেষ পরমান্ন। এই পরমান্ন থেকেই তিনি গাছ-দেবতার জন্য খাবার প্রস্তুত করেছিলেন।

পরমান্ন প্রস্তুত। সুজাতা তখন সেই অশ্বত্থ গাছের কাছে তাঁর দাসীকে পাঠিয়েছিলেন। এদিকে বুদ্ধগয়ায় তখন উপস্থিত হয়েছেন গৌতম বুদ্ধ। তাঁর নির্বাণ শেষ হয়েছে। নির্বাণের পর তিনি সেই অশ্বত্থ গাছের নিচে বসেছিলেন।  তাঁর জ্যোতিতে চারিদিক উদ্ভাসিত তখন। গৌতম বুদ্ধ প্রায় ঊনপঞ্চাশ দিন অভুক্ত ছিলেন সে সময়। সেই সময় তিনি ধ্যানে মগ্ন।

সুজাতা দাসী গৌতম বুদ্ধ কে দেখে গাছ দেবতা হিসেবে কল্পনা করে নেন। সুজাতাও বিশ্বাস করেছিলেন তাঁর ভক্তিতে গাছ দেবতার স্বয় ং উপস্থিত হয়েছেন।

নিজের হাতে তৈরি পরমান্ন তিনি গৌতম বুদ্ধের চরণে উৎসর্গ করেন। সোনার পাত্রের সেই পরমান্ন তিনি মাটিতে নামিয়ে তার ঢাকনি খোলেন। আরেকটি সোনার বাটিতে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সুগন্ধি জল। গৌতম বুদ্ধ চোখ মেলে তাকান। গ্রহণ করেছিলেন সেই পরমান্ন। ৪৯ দিন পর প্রথম তৃপ্তিতে আহার করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। খাবার পর তিনি সোনার বাটিটা নদীর জলে ফেলে দিয়েছিলেন। শোনা যায় সেই বাটি নাকি স্রোতের বিপরীতে ভেসে চলে গিয়েছিল, এতেই নাকি গৌতম বুদ্ধ নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন যে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন।

গৌতম বুদ্ধের অন্তর তখন শান্ত, সুজাতার দেওয়া পরমান্নে তিনি তৃপ্ত হয়ে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। নিজের বাকি জীবন গৌতম বুদ্ধের উপাসিকা হয়েই কাটিয়েছিলেন সুজাতা। এক সাধারণ জীবনের অনন্যা হয়ে ওঠার এই উপাখ্যানে গৌতম বুদ্ধের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবুও ইতিহাসের পাতায় এই অসাধারণ নারী সব সময় সমাদৃতা হয়ে

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...