দোরে দোরে কার্তিক ফেলার প্রথা এলো কোথা থেকে?

বিভিন্ন পুরাণে কার্তিকের জন্ম বৃত্তান্তের নানান রকমফের আছে। তবে মোদ্দা গল্পটা হচ্ছে এরকম:

তারকাসুর নামের এক অসুরকে বধ করার জন্য প্রয়োজন ছিল সাত দিন বয়সী শিবপুত্রের। ধ্যানমগ্ন শিবকে পুত্র উৎপাদনে উৎসুক করতে মদনদেব তাঁর ওপর চালালেন কামবাণ। সেই বাণের আঘাতে শিবের ধ্যানভঙ্গ হল এবং অকালে ধ্যান ভাঙানোয় শিবের মনে জাগল প্রচণ্ড ক্রোধ। খুলে গেল তাঁর তৃতীয় নয়ন। তা থেকে বেরিয়ে এলো দারুণ আগুন। সেই আগুনে ছাই হয়ে গেলেন মদনদেব। কিন্তু, ততক্ষণে কামের বাণ শিবের শরীরে ক্রিয়া করতে শুরু করে দিয়েছে। ফলে, তিনি অসম্ভব কাম তাড়িত হয়ে শুরু করলেন পার্বতীর সঙ্গে রতিক্রিয়া। 

রতিরঙ্গে কেটে গেল দীর্ঘ বত্রিশ বছর। তবু, শিবের মনে হতে লাগল এ যেন পলমাত্র সময়! এদিকে দেবতারা অসম্ভব অধৈর্য হয়ে উঠলেন। তাঁদের একটাই চিন্তা-রতিকর্ম শেষ না-হলে যে পার্বতীর গর্ভসঞ্চার হবে না! গর্ভ না-হলে পুত্রের জন্ম হবে কেমন করে! আর পুত্রের জন্ম না-হলে তারকার হাত থেকেও।যে নিস্তার নেই! দেবতারা এতটাই ধৈর্যহারা হলেন যে, হর-পার্বতীর রতিকর্মের মাঝে তাঁদের তাড়া দিতে অগ্নিকে দূত হিসেবে পাঠালেন। অগ্নি হাঁসের রূপ ধরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে শিবের কানে কানে গিয়ে শিগগির রতিকর্ম শেষ করার কথা বললেন। আর এতেই শিব-পার্বতীর আবেশ কেটে গেল, আশ্লেষ ঘুচে গেল, দু'জন দু'জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। বীর্যস্খলন হয়ে গেল শিবের। শিব সেই বীর্য অগ্নিকে ধারণ করতে বললেন। কিন্তু, হংসরূপী অগ্নি ঠোঁটে সেই বীর্য ধারণ করেও রক্ষা করতে পারলেন না। তিনি তা নিক্ষেপ করলেন আকাশগঙ্গার বুকে। আকাশগঙ্গাও তা ধারণ করতে না-পেরে নিক্ষেপ করলেন শরবনে। তখন সেই নিক্ষিপ্ত বীর্য থেকেই শরবনে জন্ম হল একটি শিশুর। 

kartikeya-body

জন্ম নিয়েই শিশুটি খিদের চোটে কেঁদে উঠল। ঠিক সেই সময় ছ’জন কৃত্তিকা স্নান করছিলেন আকাশগঙ্গায়। শিশুর কান্না শুনে তাঁরা অবাক হলেন। ছুটে এলেন শরবনে। দেখলেন, ক্ষুধার্ত শিশুটিকে। আহা, কী অপূর্ব তার রূপ! তাকে দেখে তাঁদের মনে বাৎসল্য জেগে উঠল, তাকে স্তন্যপান করানোর জন্য সকলেই একসঙ্গে অধীরা হলেন। তাঁদের সেই ইচ্ছে শিশুটি যেন বুঝতে পারল। সে তাঁদের ইচ্ছেপূরণ করতে নিজের কাঁধে আরও পাঁচটি মাথা উদ্ভূত করল। তারপর ছয় মুখ দিয়ে একসঙ্গে ছয় কৃত্তিকার স্তন্যপান করে তাদের ধন্য করল। শিশুটি এই ছয় কৃত্তিকা দ্বারা লালিতপালিত হল। তাই তার নাম হল, ‘কার্তিকেয়’ বা ‘কার্তিক’। কাঁধে ছয়টি মাথা উদ্গত হয়েছিল বলে তার নাম হল, ‘ষড়ানন’। পুরাণ মতে, কার্তিক দেবসেনাপতি এবং তিনি চিরকুমার।  

কিন্তু, পুরাণ যাই বলুন না কেন, ‘মহাভারত’ অনুসারে কার্তিক কিন্তু চিরকুমার নন। জন্মের পাঁচদিনের মাথায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন পূর্ণ যুবক এবং ছ’দিনের দিন বিয়ে করেছিলেন দক্ষের এক কন্যা দেবসেনাকে। সেটা ছিল ষষ্ঠী তিথি। বিবাহের এই তিথি থেকেই দেবসেনা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন আমাদের চিরচেনা 'ষষ্ঠী দেবী'। আর এই 'মহাভারত'-এর গল্পসূত্র থেকেই দোরে দোরে কার্তিক ফেলে খুনসুটি করার যে প্রবণতা, তার জন্ম। এবার আসি সে-প্রসঙ্গে...

'মহাভারত'-এর গল্পে কার্তিকের আর এক নাম, ‘স্কন্দ’। তিনি যে ছয় কৃত্তিকার দ্বারা লালিত-পালিত হলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ঋষিপত্নী। কিন্তু, ঋষিরা কার্তিককে মেনে নিতে পারলেন না, কৃত্তিকাদের সঙ্গে অন্য পুরুষের সম্পর্ক থেকে কার্তিকের জন্ম হয়েছে সন্দেহ করে তাঁদের তাড়িয়ে দিলেন। তখন বিতাড়িত কৃত্তিকাদের মায়ের সম্মান দিয়ে আশ্রয় দিলেন কার্তিক এবং নিজের পূজা প্রচারের কাজে লাগালেন। প্রচারের কাজটা হল একটু বাঁকা পথে। তিনি কৃত্তিকাদের বললেন যেসব ছেলেমেয়েদের বয়স ষোল পার হয়নি, তাদের নানারকম অনিষ্ট করতে। সেইসঙ্গে নিজের অনুগত যেসব ‘গণ’ কিম্বা ‘অপদেবতা’ ছিল, তাদের আদেশ দিলেন গর্ভস্থ ভ্রুণ নষ্ট করতে। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে সংসারে মানুষ পুত্রকন্যা হারিয়ে হাহাকার করে উঠল। সেই সুযোগে কৃত্তিকারা প্রচার শুরু করলেন এই বলে যে, কার্তিকের পুজো করে তাঁকে তুষ্ট করলে এইসব বিঘ্নবিপত্তি আর থাকবে না, শিশুরা নীরোগ হবে, অপুত্রক পুত্র পাবে। ফলে, অচিরেই সন্তানকামী ও সন্তানের মঙ্গলপ্রার্থী গেরস্তের কাছে পূজনীয় হয়ে উঠলেন কার্তিক। সন্তানের শুভাশুভের অধিষ্ঠাতা দেবতা হয়ে ওঠার জন্যই অনেক পরবর্তীকালে (কবে থেকে, কার্তিকই জানেন!) স্পর্শকাতর গেরস্তের দোরে কার্তিক ফেলে তাঁকে বিপাকে ফেলার প্রবণতাও শুরু হল। কারণ, দোরে কার্তিক পড়লে তাঁর পুজো না-করে বিসর্জন দিলে বা উপেক্ষা করলে যদি সন্তানসন্ততির ক্ষতি হয়! নবদম্পতির যদি সন্তান না-হয়!--এইসব আশঙ্কা থেকে ‘দোরে কার্তিক পড়লে পুজো করতেই হবে’--এমন ধারণার জন্ম। 

কার্তিক তো দেবসেনাপতি থেকে সন্ততিদের রক্ষাকারী দেবতা হয়ে উঠলেন। সঙ্গগুণে কার্তিকের পত্নী দেবসেনাও ধীরে ধীরে সন্তানের শুভাশুভের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ষষ্ঠী হয়ে উঠলেন। সেই 'হয়ে ওঠার' সময়কালটা আজ থেকে প্রায় আঠেরশো বছরেরও বেশি আগের কাল। কারণ, তখনকার যৌধেয়-মুদ্রায় একইসঙ্গে কার্তিক ও ষষ্ঠীদেবীর মূর্তি আঁকা আছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...