জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির ব্যাঙকান্দি গ্রাম। গ্রামে এখনও কাঁচামাটি আর পাথরের রাস্তা নদীর মত বয়ে চলে। মাঝে মাঝে ঢাল। তার সামনে দিয়েই বয়ে গেছে কলাখাওয়া নদী। দু’চারটে বাড়িঘর ছাড়া বিশেষ জনবসতি নেই এখানে। পাশেই ধানক্ষেত। খেত ভরে গেছে পাকা ধানে। চারপাশ জঙ্গলে। দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। স্রোতের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যের পর এই অঞ্চলে কেউ হাঁটাচলা করলে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। প্রয়োজন ছাড়া ঐ পথ দিয়ে কেউ যায় না। অন্ধকার, সাপ-খোপের ভয়, জঙ্গল, সব মিলিয়েই গা ছমছমে পরিবেশ।
কথিত আছে একবার বেশ রাত করে ওই রাস্তাটা দিয়ে একজন বাড়ি ফিরে আসছিল। কিন্তু বারবার কেউ তাকে পেছন থেকে ডাকছিল। প্রথম প্রথম লোকটার মনে হচ্ছিল এটা বুঝি তার বিভ্রম। হঠাৎ করে দেখে একটা নীল রংয়ের অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসছে। দুপাশে প্রসারিত চারটে হাত। পরনে সাদা ধুতি। গায়ে জড়ানো সাদা উত্তরীয়। সঙ্গে বাহন হিসেবে রয়েছে একটা কালো কাক। লোকটা ভয়ে জড়সড়। নীল অবয়বটাকে চিনতে পারেনি। এতে সেই নীল অবয়ব আরো রেগে যায়। লোকটাকে আক্রমণ করতে যায়। লোকটা আত্মসমর্পণ করে। বলে "আমায় ক্ষমা করুন, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। এ আমার অজ্ঞতা। আপনি কে?"
সেই নীল অবয়ব তখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে ওঠেন "আমি কাউয়ালি ঠাকুর। আমার থানে গিয়ে পুজো দিলেই আমি শান্ত হব"। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির ব্যাংকান্দি গ্রামের রাস্তা ঢালাই করা, কাঁচামাটির। এখানে কইন্যা বরের ঢ্যাম ঠাকুরের থানের পাশে টিন দিয়ে ঘেরা একটি থানে পূজিত হন কাউয়ালি ঠাকুর। তিনি লৌকিক দেবতা। রং টকটকে নীল রংয়ের। পরনে সাদা ধুতি এবং উত্তরীয়। পাশেই তার বাহন হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে একটা কাক।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এখানে নাকি বহুকাল আগেই একটা আম গাছ ছিল। আম গাছে কাউয়ালি নামের এক প্রকার আম ফলত। এই নামেই দেবতার নামকরণ হয়েছে। স্থানীয় রাজবংশী লোকেরা এই ঠাকুরের পূজো করে আসছে বহুকাল থেকে। এই ঠাকুরের পুজো না করলে নাকি কাউয়ালি ঠাকুর লোকেদের দেখা দিয়ে ভয় দেখিয়ে পুজো আদায় করেন। কথিত আছে এই ভয় থেকে গ্রামবাসীরা প্রতিবছর নিয়ম করে কাউয়ালি ঠাকুরের পুজো করেন।
কাউয়ালি ঠাকুরের পূজো হয় ধান কাটার পর অঘ্রাণ মাসে অথবা মাঘ মাসে। বছরে এই একটা দিনই পূজো হয়। নিত্য পুজোর চল নেই এখানে। মূলত স্থানীয় রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা এই পুজোটা করে। প্রতিবছর পুজোর আগে নতুন মূর্তি তৈরি করা হয়। তখন আগের বছরের মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়। পুজোয় নৈবেদ্য হিসেবে কলা,দুধ ,বাতাসা, দই, চিঁড়ে এবং নানারকম ফলমূল প্রয়োজন হয়। যেমন আপেল, শসা। পুজোর সময় ঢাকি এনে ঢাকঢোল বাজানোর রীতি রয়েছে। পুজোর পর দিন একটা ছোটখাটো মেলাও বসে এখানে। কাউয়ালি ঠাকুর এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে গেছে।