ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ কাটোয়া, কালীর জেলা পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় আছেন পাগলি কালী মা। ফি বছর অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যায় অর্থাৎ মার্গ শীর্ষ অমানিশায় পূজিতা হন কাটোয়ার পাগলি কালী মা। প্রায় অর্ধ শতাব্দী চলে আসা এই পুজোকে ঘিরে মেতে ওঠে গোটা এলাকা। শ্মশানের আধ পোড়া কাঠ, দড়ি, বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় পুজো মণ্ডপ। শ্মশানের সামগ্রী দিয়েই হয় দেবীর আরাধনা। কাটোয়া শহর ছাড়াও আশপাশের বহু গ্রাম থেকে পূণ্যার্থীরা এসে ভিড় জমান কাটোয়া বাজারের ভাগিরথীর তট। এই পুজোর বিশেষত্ব হল, তারাপীঠের মহাসাধক বামাক্ষ্যাপার বংশধর এসে পাগলি কালীর পুজোর করেন। পূণ্যার্থীদের মধ্যে পুজোকে কেন্দ্র করে আকর্ষণ থাকে তুঙ্গে। পুজোর বয়স ৫৭ বছর।
কাটোয়ার পাগলি কালী মায়ের পুজোর প্রচলন হয়েছিল বাংলার ১৩৭৪ সনে। এই পুজো প্রচলনের পিছনে রয়েছে কাহিনি। শোনা যায়, ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের গ্রীষ্মের কোনও এক দিনে ভাগিরথীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অনিল দাস, বৈদ্যনাথ সাহা ও তারা দাস নামে তিন বন্ধু নদীতে স্নান করার সময় একটি কালীমূর্তির কাঠামো ভেসে আসে তাঁদের কাছে। তাঁরা কাঠামোটি ফের স্রোতে ভাসিয়ে দেন। যতবারই তাঁরা কাঠামোটি ভাসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন ততবারই তা ঘুরে ঘুরে তাদের কাছে চলে আসে। শেষে অনিল দাস কাঠামোটি জল থেকে টেনে পাড়ে তুলে নেন। তারপর তাঁরা বাড়ি চলে আসেন। ওই দিন রাতেই দেবীর স্বপ্নাদেশ পান অনিল দাস। কাঠামোয় মূর্তি গড়ে পুজো করার স্বপ্নাদেশ দেন দেবী। পরের দিন সকালে দুই বন্ধুকে ঘটনার কথা বলেন তিনি। কী করবেন বুঝতে পারেন না তাঁরা।
এরপরই তিন বন্ধু তারাপীঠের মহাসাধক বামাক্ষ্যাপার অন্যতম বংশধর উমাপদ রায়ের দ্বারস্থ হন। তিন বন্ধুকে ওই কাঠামোতেই মূর্তি গড়ে দেবীর পুজো শুরু করার নির্দেশ দেন উমাপদ। পুজোর তিথি, পুজোর পদ্ধতি তাঁরই ঠিক করে দেওয়া। তিনি জানান, তিনিই পৌরহিত্য করবেন। বামাক্ষ্যাপার বংশধরের নির্দেশ মতো ওই বছরই পুজো শুরু হয়। তাঁর নির্দেশেই তন্ত্রমতে দেবীর পুজো শুরু হয়। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী পাশের শ্মশান থেকে মৃতদেহ পোড়ানোর আধপোড়া কাঠ ও মৃতদেহ বাঁধার দড়ি দিয়ে দেবীর মণ্ডপ তৈরি হয়। জোড়া বলি দেওয়া হয় পুজোর দিনে। আজও বামাক্ষ্যাপার বংশধরের হাতেই পূজিতা হন দেবী। উমাপদ রায়ের পুত্র সুখেন্দু বিকাশ রায় এখন পুজো করেন। কাটোয়া বাজারের ঘাটে প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যা তিথিতে এই পুজো হয়। শ্মশানঘাট থেকে বাঁশ নিয়ে মণ্ডপ বাঁধা হয়। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে শহরের শ্মশানঘাটে পড়ে থাকা জিনিসপত্র দিয়ে মণ্ডপ বেঁধে পুজো করা হচ্ছে।
মায়ের কাঠামো বারবার ভাসিয়ে দেওয়ার পরেও ঘাটে ফিরে আসছিল, সেই থেকে দেবীর নাম হয় পাগলি মা। পাগলি মা কালীর পুজো কাটোয়ার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। পুজোর নিছক পরিচয় পেরিয়ে শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক পাগলি কালী মা। শহরের মানুষের ভক্তি, বিশ্বাস ও আবেগে মায়ের পুজো করেন। পুজোর পরের দিন মহোৎসব হয়। দূর-দূরান্ত থেকেও ভক্তরা আসেন।