শিশু সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্বর্গত মহেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রধানত একজন মুদ্রাকর ছিলেন তিনি। সরস্বতী প্রেস তাঁরই হাতে তৈরি। সে সময় সরস্বতী প্রেস শুধু একটি ছাপাখানা ছিল না, দেশীয় সাহিত্যসেবার পীঠস্থান ছিল রীতিমত।
ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশদের রাজত্ব চলছে। জাতীয়তাবাদী সাহিত্যকে মানুষের কাছে বেশি করে পৌঁছে দেওয়ার বিপ্লবী মনোভাব থেকেই সরস্বতী প্রেসের পরিকল্পনা করেছিলেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯২৩ সালে এই সংস্থাটির জন্ম। মহেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে জন্ম হয়েছিল এই ছাপাখানার। তাঁর উত্তরপুরুষের হাত ধরেই এই ছাপাখানা এখনো চলছে।
শুরুর দিকে বেশ লড়াই করতে হয়েছিল মহেন্দ্রনাথ দত্তকে। ছাপাখানা জন্ম দেওয়া, তারপর তাকে লালন করা, সেখান থেকে বই প্রকাশ করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। তবে মহেন্দ্রনাথ দত্ত হাল ছাড়ার মানুষ ছিলেন না। যে পথ চলা তিনি শুরু করেছিলেন থামেননি সেই পথে। একটু একটু করে এই প্রেস এগোতে থাকে স্বমহিমায়।
ঠিক তখনই মহেন্দ্রনাথ দত্তের মনে হয় আমাদের সাহিত্য জগতে ছোটদের জন্য বাংলা ভাষায় তেমন কোন বইপত্র নেই। ইংরেজি ভাষা এই দিক দিয়ে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করে। সুন্দর, মনোরম ছবি-সম্বলিত ইংরেজি ভাষার বই বহু আগে থেকেই সাহিত্য জগতে বেশ জ্বলজ্বল করতো। সেই সব বইপত্র বাইরে থেকে এদেশে আসতো। ছোটদের মনোরঞ্জন হত তাতে।
কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় তেমন কোন বই ছাপা হয়নি তখনও পর্যন্ত। আমাদের দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অন্য ভাষার বই পড়বে! এই ভাবনা কষ্ট দিত সরস্বতী প্রেসের মালিক মহেন্দ্রনাথ দত্তকে।
১৯৪৯ সালে সরস্বতী প্রেসে প্রথমবার অফসেট প্রিন্টিং মেশিন আসে। অফসেট মেশিন আসার পরেই মহেন্দ্রনাথ দত্তের ভাবনা একটা অভিমুখ পায়। শিশুদের জন্য তিনি নানান বইপত্র প্রকাশ করার কথা চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।
এই চিন্তা ভাবনার ফলশ্রুতি ছড়ার ছবি ১ ও ছড়ার ছবি ২ । সেটাই ছিল সারা ভারতের মধ্যে অফসেটে ছাপা প্রথম ছবির বই। এই ধরনের ফরম্যাটে এর আগে ছোটদের জন্য বই তৈরি হয়নি। প্রথম প্রকাশের পরেই বইগুলি যথেষ্ট সমাদৃত হয়। এ যেন ছোট, বড় সকলের মন রামধনুর রঙে রাঙিয়ে তোলা।
ভারত তখন স্বাধীন হয়েছে। সরস্বতী প্রেসের গতি সপ্রতিভ, সাবলীল। তখনই পৃথক একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন মহেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৫১ সালের ১লা আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড।
পরবর্তীকালে ছোটদের নানান বই এই শিশু সাহিত্য সংসদ প্রকাশ করতো। সিগনেট প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ডি.কে. গুপ্ত অর্থাৎ দিলীপ কুমার গুপ্ত অনুপ্রাণিত করেছিলেন মহেন্দ্রনাথ দত্তকে। তিনি বলতেন "ভারতবর্ষ থেকে এই ধরনের কাজ আগে কখনো হয়নি"। সরস্বতী প্রেসের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি। তাঁর উৎসাহ ব্যঞ্জন মন্তব্য মহেন্দ্রনাথ দত্তকে আরো অনুপ্রাণিত করেছিল।
সুকুমার রায়ের বড় বোন সুখলতা রাও নিজের যেচে মহেন্দ্রনাথ দত্তকে চিঠি লিখেছিলেন যে "আপনারা বাচ্চাদের জন্য এত বই করছেন, আমায় কাজে লাগান।" এই আলাপের সূত্রেই সুখলতা রাওয়ের নিজে পড় এবং নিজে শেখো বইটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে অরণ্যদেব, ছোটদের নানান রঙিন বইও প্রকাশিত হয়েছে এই শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে। অন্যদিকে সরস্বতী প্রেস প্রকাশ করে গেছে বড়দের জন্য নানান রচনাবলী।
মহেন্দ্রনাথ দত্তের আবেগপূর্ণ তত্ত্বাবধানে সরস্বতী প্রেস প্রকাশনার জগতে রাজত্ব করেছে বহু বছর। একদিকে তারা পাঠকের রুচি তৈরি করেছে অন্যদিকে প্রকাশনার সৌষ্ঠব বজায় রেখেছে। বর্তমানে এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রকাশনের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে এখনো। শুধুমাত্র পুরোনো দিনের সাহিত্যের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করা নয়, অন্যদিকে এখনো সাহিত্য সেবা করে চলেছে এই প্রকাশনা সংস্থা।
পরাধীন ভারতবর্ষের সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সরস্বতী প্রেসের নাম যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভাবে পাওয়া যায়।