কালীর দেশ বঙ্গের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে কালীক্ষেত্র। দক্ষিণবঙ্গের নানান দেবীকে বড় কালী বা বড় মা হিসাবে পুজো করা হয়। নৈহাটি হোক বা কালীক্ষেত্র বর্ধমান, বড় মাকে নিয়ে ভক্তদের ভক্তির কোনও খামতি নেই। উত্তরবঙ্গেও পূজিতা হন এক বড় মা। তিনি বিরাজ করেন ধূপগুড়িতে। মন্দিরের নাম বড় কালী মায়ের মন্দির। জলপাইগুড়ি জেলা তথা ডুয়ার্সের অন্যতম প্রাচীন এবং জাগ্রত কালী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম ধূপগুড়ি মহাকুমার কালিরহাটের শতাব্দী প্রাচীন বড় কালী মায়ের মন্দির। বড় কালী মাকে ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন কাহিনি। এখন বড় কালী মায়ের বাৎসরিক পুজো। আনুমানিক ১৩০৫ বঙ্গাব্দ থেকে এই পুজো হয়ে আসছে। এ বছর বড় কালীর পুজো ১২৬ তম বর্ষে পদার্পণ করল। মায়ের পুজো দিতে দূর-দূরান্তের পুণ্যার্থীরা মন্দিরে ভিড় জমিয়েছেন।
এ বছর মাঘী পূর্ণিমায় দেবীর পুজো শুরু হয়েছে। প্রতি বছর মাঘ মাসের শুরু বা ফাল্গুনের শেষে ধূপগুড়ির বড় কালী মায়ের বাৎসরিক পুজো হয়। পুজো ঘিরে চলে উৎসব। মেলা বসে, সব মিলিয়ে পাঁচ দিন ধরে মহাসমারোহে বড় কালীর পুজোর আয়োজন করে ধূপগুড়িবাসী। বাংলার পাশাপাশি ভিন রাজ্য অর্থাৎ অসম, ভুটান, নেপাল থেকেও পুণ্যার্থীরা আসেন, পুজো দেন। কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয়। মন্দিরে বলিদানের রীতি এখনও রয়েছে। এক হাজারের মতো পাঁঠা এবং পাঁচ হাজারের বেশি পায়রা উৎসর্গ করা হয় দেবী কালিকাকে। নিজেদের মনস্কামনা পূরণ করার জন্য মন্দিরে পায়রা উৎসর্গ করার রেওয়াজ রয়েছে ভক্তদের। ভক্তদের মতে, এই মন্দিরের কালীমাতা খুবই জাগ্রত। ভক্তিভরে প্রার্থনা করলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়।
এখন যেখানে মন্দির, সেই মন্দিরের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা সোনাখালি পর্যন্ত গিয়েছে। রাস্তাটি এখন পাকা হলেও এক সময় ছিল জঙ্গলে ঘেরা কাঁচা মাটির রাস্তা। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবতারা যাতায়াত করার জন্য রাতারাতি রাস্তা তৈরি করেছিলেন। রাস্তার নাম দেওয়া হয়েছিল দেওমালী। এই রাস্তা দিয়েই কালী মা এই মন্দিরে আসতেন। কার্তিক মাসে দীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে মা কালীর পুজো হত। একদা স্থানীয় এক ব্যক্তির একমাত্র ছেলে হারিয়ে যায়। তিনি কালীর কাছে মানত করেন যদি মা কালী ছেলেকে খুঁজে এনে দেন, তাহলে তিনি ফাল্গুন মাসে দেবীর পুজো দেবেন।
এরপর এক রাতে হঠাৎই বাড়িতে ফিরে আসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ছেলেটি। তাঁর বাবা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কে তাকে এনে দিল? উত্তরে ছেলে বলেছিল, এক বৃদ্ধা বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও বৃদ্ধার খোঁজ পাওয়া যায়নি, পরিচয় জানা যায়নি। তখন থেকেই লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায়, বড় কালী মা নিজে নিখোঁজ ছেলেকে পথ দেখিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। ছড়িয়ে পড়ে মায়ের মাহাত্ম্য ও কৃপার কথা। সেই থেকে ফাল্গুন মাসে পুজো শুরু হয়। তখন থেকেই পুজোর সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। কালীর নাম অনুসারে এলাকার নাম হয় কালীরহাট।
মন্দিরে মায়ের মূর্তি মৃন্ময়ী, চতুর্ভুজা দেবী বিরাজ করেন সেখানে। দেবীর গাত্র বর্ণ নীল। পদতলে থাকেন ভোলানাথ। দু-পাশে থাকে ডাকিনি ও যোগিনী। একদা টিনের তৈরি মন্দিরে বড় কালী মায়ের পুজো হত। দীর্ঘকাল যাবৎ পুরনো মন্দিরে পুজো হলেও মন্দির কমিটি নতুন পাকা মন্দির নির্মাণ করেছে। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ যেকোনও রকম শুভ কাজ করার আগে এই মন্দিরে পুজো দেন। ভক্তদের দাবি, ভক্তি ভরে মায়ের কাছে প্রার্থনা করলে তিনি মনস্কামনা পূরণ করেন। নির্বিঘ্নে কাজ সম্পন্ন হয়। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বড় কালীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে।