চারপাশে হিমালয়। মাঝখানে অর্কিডের জঙ্গল আর নরম সবুজ ঘাসে ঘেরা জমি। বাপসা নদীর খরস্রোতে ভিজে থাকে মাটি। নীল আকাশে মুখ ঢাকা পাহাড় আর হিমালয়ের হাওয়াও অদ্ভুত মৌতাত।
সম্প্রতি ইমতিয়াজ আলি পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘লাভ আজকাল’-এর চোখ জড়ানো এই লোকেশনে দেখে মুগ্ধ হননি এমন দর্শক পাওয়া যাবে না। ছবিতে মুগ্ধতা যত না তার চেয়ে যেন অনেক বেশি নজর টেনেছিল পাহাড়ী গ্রামখানা।
তবে এই লোকেশন বিদেশের কোনও ‘কান্ট্রিসাইট’ নয়, হিমাচল প্রদেশের ছোট্ট এক গ্রাম। নাম চিটকুল। মানচিত্র যাকে চেনায় ইন্দো- তিব্বত সীমান্তে ‘ভারতের শেষ ভূখন্ড’ হিসেবে।
দৈনন্দিন গ্লানি সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলার সাংলা উপত্যকায় অবস্থিত গ্রাম চিটকুল বা ছিটকুল।
এই গ্রাম থেকে তিব্বত সীমান্ত খুব দূরে নয়। ১১৩৫১ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।
স্লেট পাথর আর কাঠের বাড়ির গ্রাম মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলায় দেখা পোস্ট কার্ডের কথা। দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় জন সংখ্যাও বেশ কম। সব মিলিয়ে ২৫০ ঘর লোকের বাস।
হিমালয়ের অন্যান্য পাহাড়ী গ্রামের মতোই চিটকুল গ্রামকে নিয়েও আছে নানা মিথ আর গল্প।
হিমাচলের এই গ্রামটিতে মাথি দেবীর বাস। তিনি বদ্রীনাথ দেবের স্ত্রী। একবার বৃন্দাবন ভ্রমণে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে চিট কুলে এসে মুগ্ধ হলেন। ইচ্ছে হল প্রকৃতির কোলে অসাধারণ সুন্দর এই গ্রামটিতে কিছুদিন থেকে যাওয়ার।
স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস মাথি দেবী এই গ্রামে সদা অধিষ্ঠাত্রী। তিনি সমস্ত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন।
হিমাচলের লোককথাতেও মাথি দেবীর চিটকুল বাসের কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। চিটকুলের পাশের গ্রাম কামরুতে থাকেন প্রভু বদ্রীনাথ।
ভারতের একদম অন্তিম বিন্দুতে অবস্থান করা এই পাহাড়ী গ্রামটিকে জানবার সব চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পায়ে-পায়ে ঘুরে দেখা।
এবড়ো- খেবড়ো সর্পিল পথ পায়ে হেঁটে দেখা নিরাপদও বটে।
চিটকুলে একটি কেল্লা আছে। সম্পূর্ণ পাথরে তৈরি। তিনতল বিশিষ্ট কেল্লার বাকি অংশ অবশ্য কাঠের।
পাঁচশো বছরের পুরনো মাথি দেবীর মন্দিরের টানে এই গ্রামে আসেন বহু মানুষ। হিমাচলের এই প্রান্তের মানুষের কাছে তিনি সমৃদ্ধির দেবী। কাঠ এবং পাথরের তৈরি মন্দিরটি কিন্নরী স্থাপত্যের আদর্শ উদাহরণ।
তবে বেড়াতে ভালোবাসা মানুষদের কাছে চিটকুল চিরকালের আদরের তার ‘ল্যান্ডস্কেপ- বিউটি’র জন্য। নীল ঢাকা সবুজ পাহাড়ের ওপরে রঙ- বেরঙের কাঠের বাড়ি। কিন্তু প্রতিটি বাড়ির আকার বা আয়তন আলাদা আলাদা। কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।
পর্যটকদের কাছে চিটকুলের বাড়তি আকর্ষণ থাকলেও দুর্গমতা বড় বাধা। যখন তখন বরফপাত, প্রতিকূল প্রকৃতি, অত্যন্ত সরু রাস্তা, বিপদজনক বাঁক পার হয়ে ইচ্ছে থাকলেও পৌঁছানো সম্ভব হয় না সকলের।
ইনস্টাগ্রাম, সেলফি, সোশ্যাল মিডিয়ার সুযোগ তো অনেক দূর। জীবনযাত্রাও কঠিন। তবু ‘অফবিট ডেস্টিনেশন’ যারা খোঁজেন তাদের কাছে চিটকুল অবশ্য গন্তব্য।
পাঁচশো বছরের পুরনো মন্দির, দুর্গ আর অনাবিল প্রকৃতি নিয়ে অপেক্ষা করে শেষ প্রান্তের এই অন্তিম ভূখন্ড। জীবনযাত্রার সুযোগ সুবিধা, পথের বাধা, অনিশ্চয়তার দোহাই ম্লান হয়ে যায় উন্মুক্ত প্রকৃতির দুর্নিবার আকর্ষণের কাছে।