ক্যারিবিয়ান স্বর্ণযুগের শেষ ক্রিকেটার

সালটা ১৯৬২, এন্টিগার ফাইভ আইল্যান্ডে ১২ জানুয়ারি আজকের দিনে জন্ম গ্রহন করেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সোনালীযুগের শেষ প্রতিনিধিদের অন্যতম রিচি রিচার্ডসন। জন্ম অনেক লড়াই করে উঠে আসা এই ক্যারিবিয় একাধারে সোনালী অতীতের সাক্ষী আবার অন্যধারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের দুর্দশা তাঁর আমলেই শুরু হয়।

১৯৭৯ সালে এন্টিগার হয়ে খেলেই ডাক পান লিওয়ার্ডের হয়ে অনূর্দ্ধ ১৯ দলে। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে অনূর্দ্ধ 19 টেস্ট খেলেন । তাঁর খেলা দেখে গ্ল্যামরগ্যান সেকেন্ড ইলেভেন তাঁকে খেলায় এবং গ্ল্যামরগ্যানের অনূর্দ্ধ ২৫ দলে সুযোগ পান ।

১৯৮১-৮২ সালে লিওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জের হয়ে প্রথম শ্রেণীর খেলা শুরু করেন রিচি রিচার্ডসনবার্বাডোসের বিরুদ্ধে ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বে তাঁর অভিষেক হয়। কিন্তু ওপেন করতে নেমে জোয়েল গার্নারের বলে পেনের হাতে ক্যাচ দিয়ে শূন্য রানে আউট হন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৬ রান করেন। এবারও তিনি ছিলেন গার্নারের শিকার।পরের মরসুমে বার্বাডোজের বিরুদ্ধেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শতরান করেন।

 

richierichardson1

 

ইতিমধ্যে আরও কিছুদিন খেলার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁকে ভারতে নিয়ে আসে ১৯৮৩-৮৪ সালে বিশ্বকাপ-উত্তর ঐতিহাসিক সিরিজে। এরপর চারটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে তিনি টানা ব্যর্থ হন। সেন্ট্রাল জোনের বিরুদ্ধে ২১ এবং ২ রান করেন। প্রথম ইনিংসে তাঁকে আউট করেন মধ্যপ্রদেশের প্রবাসী বাঙালি প্রদীপ ব্যানার্জি। পরের ম্যাচে দক্ষিণাঞ্চলের বিরুদ্ধে ২৯ রান করেন। উত্তরাঞ্চলের বিরুদ্ধে করেন যথাক্রমে ৪৭ ও ২৬ রান। বোর্ড প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রহ ছিল ০ এবং ২৪।

অবশেষে পশ্চিমাঞ্চলের বিরুদ্ধে তিনি ব্যাট হাতে সফল হন। সেই ম্যাচে তিনি করেন ৭৭ ও ৬১ রান। তারপরেই বোম্বাই টেস্টে তাঁর অভিষেক হয়। কিন্তু সেখানে তাঁর সংগ্রহ ছিল ০ এবং ২৬। এরপরেই পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে বারবাটি স্টেডিয়ামে সফরে তাঁর শেষ ম্যাচ খেলেন এবং তাতে ৪৩ রানে দিলীপ দোশীর বলে আউট হন। এই ম্যাচে তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমত, এই ম্যাচে রিচি রিচার্ডসন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর ১০০০ রান পূর্ণ করেন। দ্বিতীয়ত, এই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে অরুণ লাল আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন। তৃতীয়ত, এই ম্যাচটিই ছিল পলাশ নন্দীর জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ।

এরপর দেশে ফিরে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লিওয়ার্ডসের হয়ে খেলতে নামেন এবং দুই ইনিংসেই শূন্য রান করেন। তাঁর কেরিয়ার যখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে, তখন ত্রিনিদাদের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে তাঁর ১৬২ তাঁকে আবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে সুযোগ পাইয়ে দেয়। যদিও এই টেস্টেও প্রথম ইনিংসে তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি। দ্বিতীয় ইনিংসে জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে করতে হত ৩২৩ রান। ডেসমন্ড হেইন্স এবং গর্ডন গ্রিনিচের জুটি প্রথম উইকেটে ৬১ ওভারে ২৫০ রান তোলার পর ম্যাচ ড্র হয়ে যায়। দুজনেই সেঞ্চুরি করেন, তাই রিচার্ডসনের পক্ষে এই ইনিংসে ব্যাট করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পরের টেস্টে তিনি ১৩১ নট আউট থাকেন, যা তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে দেয়নি।

 

richierichardson2

ইতিমধ্যে সমারসেটের সেকেন্ড ইলেভেনের হয়ে এবং ডারহ্যামের স্থানীয় লিগে তাঁর খেলা হয়ে গেছে। লয়েডের অবসরের পর রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ আরও পরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। রিচার্ডসন সেই দলের অবিচ্ছ্যেদ্য অঙ্গ ছিলেন। তাছাড়া তাঁদের দুজনকে বলা হত 'রিচার্ডস এন্ড হিস সন'

১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠতে না পারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে এক বিরাট ধাক্কা ছিল। ইতিমধ্যে দলে এসে গিয়েছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোজ, কার্ল হুপারের মতো খেলোয়াড়েরা। রিচার্ডস অবসর নিলে রিচার্ডসন নেতৃত্বে আসেন অনেক সিনিয়রকে টপকে। আর এখানেই বিতর্কের সূত্রপাত। আজও বহু লোক মনে করেন, রিচার্ডস, মার্শাল, দুঁজো, লোগি এঁদের অপসারণের পেছনে রিচার্ডসনের বড়ো হাত ছিল। ততদিনে অবশ্য ব্রায়ান লারা এবং প্যাট্রিক প্যাটারসনরা এসে গিয়েছেন। কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রভাব আস্তে আস্তে কমছে। তবুও তাঁরা প্রবল প্রতাপশালী।

 

richierichardson3

 

১৯৯২ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ধরাশায়ী হয়। একমাত্র প্রাপ্তি ব্রায়ান লারা। এরপরেই রিচার্ডসন দু'বছর কাউন্টি খেলেন ইয়র্কশায়ারের হয়ে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপ লিগের ম্যাচে তাঁর লড়াই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জিতিয়েছিল। ২১ বছর বয়সী রিকি পন্টিংয়ের সেঞ্চুরি যার ফলে ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু একই লড়াই ব্যর্থ হয় সেমিফাইনালে। এরপর আর তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি।

এই মরশুমেই লিওয়ার্ডের হয়ে শেষবার খেলেন। তারপর দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৯৬-৯৭ মরশুমে নর্দান ট্রান্সভালের হয়ে খেলেন। পরের মরশুমেই দেশে ফিরে আসেন কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী উইনওয়ার্ডের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেন লিওয়ার্ডের বদলে। পরের বছর ১৯৯৮-৯৯ মরশুমে আন্টিগা ও বারবুডার হয়ে কমনওয়েলথ গেমসে খেলতে যান। ২০০০-০১ সালে বাস্তা কাপে আবার প্রথম শ্রেণীর খেলা শুরু করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বি দলের অধিনায়ক হিসেবে।

 

richierichardson4

 

ওই প্রতিযোগিতায় শেষ ম্যাচে জামাইকার বিরুদ্ধে খেলেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের শেষ রত্ন ক্রিস গেইলকে দেখেছিলেন সেই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালাতে(২০৮ নট আউট)। এরপরে আর তিনি প্রথম শ্রেণী বা লিস্ট এ খেলেননি, তবে ব্যাট তুলে রাখেননি আরও ৯ বছর। ল্যাসিথ ওয়ার্ল্ড ইলেভেনের হয়ে ৩৯টি ম্যাচ ২০০৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন। ২০১০ সালে শেষবার ব্যাট হাতে নামেন প্লেয়ারস দলের হয়ে জেন্টেলম্যান দলের বিরুদ্ধে একটি কুড়ি ওভারের খেলায়।

৮৬টি টেস্টে ৫৯৪৯ রান(১৬টি সেঞ্চুরি সহ), ২৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১৪৬১৮ রান(৩৭টি সেঞ্চুরি সহ) তাঁর নামে লেখা আছে। ২২৪টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ৫টি সেঞ্চুরি সহ ৬২৪৮ রান তাঁর ঝুলিতে। লিস্ট এ ম্যাচে ৩১৩টি খেলায় ৬টি সেঞ্চুরি সহ ৮৪৫৮ রান আছে তাঁর। মাঝে মাঝে মিডিয়াম ফাস্ট বল করতেন। সোনালি যুগের অতীতের শেষ চিহ্ন ধুসর ভবিষ্যতের সুত্রপাতকারী রিচি রিচার্ডসন আজ ৫৯ বছরে পড়লেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...