এক প্রকান্ড জলাশয়। গুরু নানক এই জলাশয়ের নাম রেখেছিলেন অমৃতসায়র। ভেবেছিলেন তার তীরে মন্দির গড়ে তুলবেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেন গুরু অর্জুন সিং।
অমৃত সায়র-এর ধারে স্বর্ণ মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে।
প্রতি সন্ধেয় সোনার দীপ্তিতে চোখ ধাঁধানো স্বর্ণমন্দির সারা পৃথিবীর আকর্ষণ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসে এই মন্দির দেখতে। সোনার তৈরি মন্দির যদি এক আকর্ষণ হয় তাহলে অন্য আকর্ষণ অবশ্যই ‘গুরুজি কা লঙ্গরখানা’
হাঁকডাক ,ব্যস্ততা, বাসনপত্রের ঝনঝনানি আর ঘি-মাখনের গন্ধে সদা চঞ্চল এই রসুই ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কমিউনিটি কিচেন’।
৫০ কুইন্টাল আটা, ১৪ কুইন্টাল চাল, ৬০০ কেজি ডাল, ৩০০ কেজি আলু, ৪০ কেজি পেঁয়াজ, ১০ কেজি ঘি, ৭ কুইন্টাল দুধ লাগে রোজ । বহু মানুষ এখানে এসে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। দুপুরের খাবার তৈরিতে হাত লাগান। কেউ কাউকে কিছুই বলে না। একে অপরকে দেখে এগিয়ে আসেন।
ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, ক্ষীর- ভোজ চলে সারাদিন- সারারাত।
এখানে যেসব স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেন তাঁদের ‘সেবাদার’ বলা হয়। লম্বা লাইন পড়ে। তাই মাঝরাত থেকে চালু হয়ে যায় স্বর্ণমন্দিরের হেঁশেল।
সকাল ৬ টা পর্যন্ত টানা রান্না হয়। খাবার পরিবেশন শুরু হয় সকাল ১১ টা থেকে। এই পর্ব চলে দুপুর ৩টে পর্যন্ত। তারপর আবার রাত ৯ টায়। গুরুজির লঙ্গরখানায় বিনামূল্যে চলে এই আয়োজন। হাজার হাজার মানুষ আসেন।
শুধু বিশ্বাস আর ভক্তির জোরেই দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির। সেই জোরেই চলে এই নিত্য ব্যবস্থা। পঞ্জাবের প্রতিটি কৃষক তাঁদের জমিতে মরসুমের প্রথম ফসল পাঠান স্বর্ণমন্দিরের সেবায়। এ কোনও প্রথা নয়, একেবারেই নিজস্ব ভালোবাসায় পাঠান তাঁরা। ক্ষেত, ফসল আর মরসুমের মঙ্গলকামনায়।
প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ লঙ্গরে নিয়মিত খান। ছুটি এবং বিশেষ উৎসবের দিনে সেই সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
১৪৮১ সাল থেকেই চলছে গুরুজীর লঙ্গর। দিনের পর দিন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই মহাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হচ্ছে সেবাদারদের অকুণ্ঠ পরিশ্রমের জন্যই। তার মধ্যে ৯০ শতাংশ-ই স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছা সেবক হওয়ারও নানারকম নিয়ম আছে। কেউ এক দিনের জন্য হন আবার কেউ কয়েকঘন্টার জন্য হন। নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে যে কেউ হতে পারে।
এই মন্দিরে একটি রুটি তৈরির বিশেষ মেশিন আছে যা একঘন্টায় ২৫ হাজার রুটি তৈরি করে প্রতিদিন।
বৈশাখীতে আলাদা হেঁশেল চালু করা হয়। শুধুমাত্র জিলিপি তৈরি হয় সেখানে।
মন্দিরে হেঁশেলেই তৈরি করা হয় বিখ্যাত কড়া প্রসাদ। আসল ঘি দিয়ে তৈরি এই প্রসাদে গন্ধ মাতোয়ারা করে দেয়
অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির ষোড়শ শতাব্দীতে চতুর্থ শিখ গুরু গুরু রাম দাস সাহেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এর নির্মাণের দুই শতাব্দী পরে মহারাজা রঞ্জিত সিংহ দ্বারা ১৮৩০ সালে মন্দির কে ১৬২ কেজি সোনা দিয়ে আবরণ করে দেন। সেই সময় যার আনুমানিক মূল্য ছিল ৬৫ লক্ষ টাকা।
গুরু রামদাস লঙ্গর আয়তন ৫০,০০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে । এটি দু-ভাগে বিভক্ত। একসঙ্গে ৫০০০ মানুষ এখানে বসে খেতে পারেন। এখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ বিশেষে মানুষে মানুষে কোনও ভেদাভেদ করা হয় না। যে কেউ এখানে এসে পেট ও মন ভরে দিন বা রাতের আহার সারতে পারেন।