বাইশ গজের রাজা শচীন তেন্ডুলকার

আজ থেকে আড়াই দশক আগের কথা। সেটাও এপ্রিল মাস। শারজা, ২২ এপ্রিল, ১৯৯৮। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ত্রিদেশীয় সিরিজের শেষ লিগ ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছে ভারত। ২৮৫ করলে জিতবে আর ২৫৪-তে পরবর্তী পর্যায়ে পৌছবে। হঠাৎই শুরু বালির বেপরোয়া দাপট! মরুঝড়— যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, “Blizzard!” মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত দেখা দায়। ২৫ মিনিট পরে ফের ২২ গজ প্রস্তুত হল। ঘটল বদল হিসেবের অংকে। ৪৬ ওভারে চাই ২৭৬। আর ফাইনালের টিকিট পেতে ২৩৭। স্টিভ ওয়া খুশি,ভাবছিলেন, ওয়ার্ন-ক্যাসপ্রোইচ-ফ্লেমিং সম্বলিত বোলিং ব্রিগেডের বিরুদ্ধে ২৭৬ বলে ২৭৬!— একি সোজা কথা।

একজন ছিলেন ভারতের হয়ে নাম, শচীন রমেশ তেন্ডুলকর। ফাইনালের দিন তাঁর আবার জন্মদিনও বটে। সেইদিন দলকে যদি ট্রফি তুলে দেওয়া যায়, তাহলেই তো জন্মদিনের সেরা রিটার্ন গিফট হবে। আগে তো এই লড়াই উৎরাতে হবে। শুরু হল দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। যদিও ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত হওয়ার পরপরই ড্যামিয়েনের ফ্লেমিংয়ের একটা জীবনঘাতী শর্ট বলে সব শেষ! ৪৬ ওভারে ভারত ২৫০/৫। ফাইনালের আগে মানসিকভাবে অজিদের সম্পূর্ণরূপেই তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে সেই বিধ্বংসী ঝড় যা ইনিংস বিরতিতে ঘটে যাওয়া বালির ঝড়কেও ১০ গোল দিয়ে প্রকৃত পক্ষেই হয়ে উঠছে মরুঝড়! হ্যাঁ, মাত্র ১৩১ বলে ১৪৩; ৯টি চার এবং ৫টি ৬ সহযোগে। প্রকৃত অর্থেই মরুঝড়। বাকিটা ইতিহাস। ২০০৩-এর পাকিস্তান ম্যাচেও এমন সংহার মূর্তি ধরেছিলেন সচিন।

Sachin-002

প্রায় আড়াই দশকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ার। ৩৪ হাজারের বেশি আন্তর্জাতিক রান। একশো আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। অসংখ্য ম্যাচ উইনিং ইনিংস। যা শচীন তেন্ডুলকারকে ক্রিকেট ঈশ্বরের তকমা দিয়েছিল। ১৩৫ কোটি ভক্তের ভগবান তিনি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার। ২২ গজকে বিদায় জানানোর পরও কেটে গিয়েছে ৯ বছরের বেশি সময়। তবে মাস্টার ব্লাস্টারের জনপ্রিয়তায় যে এতটুকু ঘাটতি পড়েনি।

শচীন তেন্ডুলকরের জন্ম হয়েছিল মুম্বাইতে ১৯৭৩ সালের ২৪শে এপ্রিল। শচীন জন্মেছিলেন নেহাতই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। মারাঠি ব্রাহ্মণকে ২২ গজই করে তুলেছে মাস্টার ব্লাস্টার। ​রমেশ তেন্ডুলকর ও মাতার নাম রজনী তেন্ডুলকরের কনিষ্ঠ পুত্র, ছোটবেলায় থেকেই ছিলেন খুব দুরস্ত। শচীন, অবিনাশ আর সুনীল ছিলেন তিন বন্ধু। তিন জন আমগাছে চড়ে মজা করতেন। বয়স্ক লোকেদের নজরে পড়ে গেলে ছুটে পালিয়ে যেতেন। গরমের ছুটিতে তিনমূর্তি সারাদিন শুধু খেলে বেড়াতেন। কখনও ক্রিকেট, আবার কখনও লুকোচুরি, আবার সাইকেল ভাড়া নিয়ে এখানে সেখানে যাওয়া। কোন ব্যাপারেই বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ছিল না সেদিনের বালকের। তারপর রমাকান্ত আর্চারেকরের ক্যাম্প! সেই থেকেই শুরু উত্তরণের যাত্রা। কৈশোরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক, আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৮৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক করেন মাস্টারব্লাস্টার। ২৪টা বছর তিনি কাটিয়ে বাইশ গজকে বিদায় জানান ২০১৩ সালে। ক্রিকেটের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে তাঁর নাম। বর্ণাঢ্য কেরিয়ারে অজস্র রেকর্ড ভেঙে নতুন মাইলস্টোন তৈরি করেছেন। সেঞ্চুরির সেঞ্চুরির মালিকের কীর্তির অন্ত নেই। আজও আসমুদ্র হিমাচলে ধ্বনিত হয় “শচীন…শচীন!”

Sachin-Family

শচীনই একমাত্র ক্রিকেটার যার ১০০টি সেঞ্চুরি রয়েছে। টেস্টে ৫১টি এবং ওয়ান-ডে ক্রিকেটে ৪৯টি। যে সংখ্যা আজও কেউ স্পর্শ করতে পারেননি। টেস্টে এবং ওয়ান-ডে ফর্ম্যাট মিলিয়ে সর্বোচ্চ রানের মালিক তিনি। টেস্টে ১৫, ৯২১ রান করেছেন তিনি। পঞ্চাশ ওভারের ফর্ম্যাটে করেছেন ১৮,৪২৬ রান। একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ক্রিকেটের তিন ফর্ম্যাট মিলিয়ে ৩০ হাজার রান করেছেন তিনি।শচীনই সবচেয়ে বেশি টেস্ট (২০০) ও ওয়ান-ডে ম্যাচ (৪৬৩) খেলেছেন। টেস্টে ক্রিকেটে ২০ বার ১৫০ প্লাস স্কোরার নজির রয়েছে শচীনের। শচীনই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি আইসিসির প্রতিটি সদস্য দেশ যারা টেস্ট খেলে, তাদের বিরুদ্ধে শতরান করেছেন।

শচীন এক ক্রিকেটিয় ক্যালেন্ডার বর্ষে ৬ বার টেস্টে ১০০০ রান করেছেন। ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১, ২০০২, ২০০৮ ও ২০১০ সালে এই নজির গড়েন তিনি। শচীন ১৭ বছর ১৯৭ দিনের মাথায় প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন। এত অল্প বয়সে কোনও ভারতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি করতে পারেননি। রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে শচীন ২০ বার শতরানের বেশি রানের পার্টনারশিপ করেছেন টেস্টে। কোনও জুটির পক্ষে ক্রিকেটের দীর্ঘতম ফর্ম্যাটে এটি বিশ্বরেকর্ড। শচীন ৫১টি টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে ২২টি ঘরের মাঠে ও ২৯টি বিদেশের মাটিতে করেছেন। বিদেশের মাটিতে এত সংখ্যক টেস্ট সেঞ্চুরি অন্য কোন ক্রিকেটারের নেই। এই গ্রহের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ান-ডে ক্রিকেটে দ্বিশতরান করেন শচীন। ১৯৯৮ সালে শচীন ১৮৯৪ রান করেছিলেন। আজও এক ক্যালেন্ডার বর্ষে এত রান আর কেউ করতে পারেননি। ১৯৯৮ সালে শচীন ৯টি সেঞ্চুরি করেছিলেন। এক বছরে আর কেউ এত সেঞ্চুরি করতে পারেননি। এই রেকর্ড আজও অক্ষত। একক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সেঞ্চুরি করেছেন শচীন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৯ বার ওয়ান-ডে শতরান করেছেন তিনি।

ওয়ান-ডে'তে শচীন ২০১৬টি চার মেরেছেন। এত বেশি চার আর কেউ মারতে পারেননি। শচীন তাঁর ২০০ রানের ইনিংসে ২৫টি চার মেরেছিলেন। এক ইনিংসে এত চার মারারাও রেকর্ডও তাঁর দখলে। সবচেয়ে বেশিবার ম্যাচ সেরা হয়েছেন শচীন। ৬২ বার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন তিনি। এমনকি বিশ্বকাপেও সর্বাধিক; ৯ বার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছেন তিনি। ম্যান অফ দ্য সিরিজ হয়েছেন ১৫বার। এটাও নজির। প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ ৭৬ বার এবং প্লেয়ার অফ দ্য সিরিজ ২০ বার হয়েছেন তিনি। বলার অপেক্ষা রাখে না; এও নজির!

Sachin-001

১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত টানা ১৮৫টি আন্তর্জাতিক ওয়ান-ডে খেলেছেন তিনি। চটজনিত কারণেও বিরাম নেননি। এটাও রেকর্ড। টপ অর্ডারে শচীন এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ওপেন করতে নেমে ২৬ বার শতরানের অধিক পার্টনারশিপ করেছেন। এর মধ্যে ২১বার জুটি বেঁধে শতরানের পার্টনারশিপ করেছেন ওপেন করতে নেমে। দুটোই রেকর্ড। শচীন-সৌরভ জুটি বেঁধে ৮২২৭ রান করেছেন। ওপেন করতে নেমে ৬৬০৯ রান পেয়েছেন। দু’টোই মাইলস্টোন।

শচীন ৯০টি আলাদা আলাদা মাঠে ক্রিকেট খেলেছেন। যা আর কেউ করেননি। শচীন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৩০৭৭ করেছেন। সব ফর্ম্যাট মিলিয়ে আর কেউ শচীনের চেয়ে বেশি অজিদের বিরুদ্ধে রান করতে পারেননি। ২০১১-তে শেষবার বিশ্বকাপ খেলেন শচীন। ক্রিকেটের মেগাইভেন্টে তাঁর ২২৭৮ রান রয়েছে। এত রান আর কেউ করতে পারেননি। বিশ্বকাপে সর্বাধিক ৬টি সেঞ্চুরি ও ২১টি ফিফটি প্লাস রান করেছেন। ২০০৩ বিশ্বকাপে শচীন সাতবার ফিফটি করেছিলেন। টুর্নামেন্টে পেয়েছিলেন ৬৭৩ রান করে সিরিজের সেরাও হয়েছিলেন।পাকিস্তানের জাভেদ মিঁয়াদাদ আর শচীন সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ খেলেছেন। দু’জনেই ৬ বার খেলেছেন। শচীন একমাত্র ক্রিকেটার যিনি রঞ্জি, দলীপ এবং ইরানি ট্রফির অভিষেকে সেঞ্চুরি করেন। ১৯৯০-৯১ সালে প্রথম বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে ইয়র্কশায়ারে হয়ে কাউন্টি খেলেছেন তিনি।

Sachin-bharat-ratna

২০১৪ সালে শচীন প্রথম ভারতীয় ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন। এর আগে কোনও ক্রীড়াবিদ এই সম্মান পাননি। এছাড়াও শচীন অর্জুন পুরস্কার, রাজীব গান্ধী খেলরত্ন, পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণেও ভূষিত হয়েছেন।

​আজ ২৪ এপ্রিল। ৪৯ বছরে পা দিলেন শচীন তেণ্ডুলকর। বাইশ গজকে বিদায় জানানোর এতগুলো বছর পরেও ‘ক্রিকেটের ঈশ্বর’ পূজিত হচ্ছেন ভক্তদের মনে। আজও তিনি আর ভারতীয় ক্রিকেট কার্যত; সমার্থক, যতক্ষণ তিনি ২২ গজে থাকতেন, ততক্ষন ভারতীয়দের ভরসা থাকত, আমরা জিতবোই। আজ আর ২২ গজে থাকেন না শচীন। কিন্তু তবুও ভারতীয় ক্রিকেট ফ্যানদের মনে মনে ধ্বনিত হতে থাকে শচীন... শচীন...শচীন ! শুভ জন্মদিন লিটিল মাস্টার!

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...