সুন্দর দ্বীপের রাজা

যদি একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করা যায়, তাহলে সাফল্য একদিন ধরা দেবেই-তা নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন তুষার কাঞ্জিলাল। রবিঠাকুরের জীবনধারায় নিজেকে দীক্ষিত করেছিলেন তুষারবাবু। আসলে রবিঠাকুর যেমন গ্রামের উন্নতিকল্পে শ্রীনিকেতনে গড়ে তুলেছিলেন আদর্শ গ্রাম, ঠিক সেই রকমই তিনিও চেয়েছিলেন পিছিয়ে পড়া, বলা ভালো বিলীন হয়ে যেতে বসা একটি গ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে।

সুন্দরবনের ছোট্ট একটি গ্রাম রাঙাবেলিয়া। ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছিল এই গ্রাম। শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন তুষারবাবু। লবণাক্ত মাটি, ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, জলাজমি এবং এখানকার মানুষের সরলতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

      ঘুরেছিলেন দেশ-বিদেশের বহু জায়গায়। ১৯৬৭ সালে সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নেই। পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তা, শিক্ষা কিছুই পৌঁছয়নি সেখানে, স্বাস্থ্যের হাল তো কহতব্য নয়। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনোমতে বেঁচে ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার। ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ সরকারই সুন্দরবনকে ধ্বংস করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো অবক্ষয় হয়েছে। তাই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পণ করেছিলেন তুষার কাঞ্জিলাল।

     রাঙাবেলিয়ার মানুষের উন্নতিসাধন করাও ছিল তার ব্রত। তাই সেখানেই তিনি থেকে গেলেন পাকাপাকিভাবে। নিজের পেশা শিক্ষকতা করার পাশাপাশি সমাজের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে। প্রান্তিক এলাকাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রযুক্তির আলো। একটু একটু করে উন্নয়নের দিকে এগোতে শুরু করল সুন্দরবন। রাঙাবেলিয়ায় পাকা রাস্তা থেকে শুরু করে পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা সব কিছু নিজে হাতে করেছেন তুষারবাবু। স্থানীয় জীবনযাপনেও উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে চেয়েছিলেন তুষারবাবু। সেই জন্য ওই এলাকার জন্য উপযুক্ত কৃষি পদ্ধতিতে চাষের কাজে পটু করে তুলেছেন গ্রামবাসীদের। তাদের নিজের হাতে তৈরী নানান সামগ্রীকে নিয়ে এসেছেন কুটির শিল্পের আওতায়। বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্পও চালু করেছেন। এইভাবেই গ্রামবাসীদের মধ্যে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন তুষারবাবু।

     তবে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের ক্ষয়রোধ করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। প্রকৃতির রোষে প্রতিদিনই প্রায় ধ্বংস হচ্ছিল অরণ্য। এমনিতেই নোনা মাটি হওয়ার দরুণ সুন্দরবনের মাটির বাঁধন বেশ আলগা। পাশাপাশি রয়েছে একদল অর্থলোভী মানুষ। যারা অর্থের জন্য ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে চলেছে। কিন্তু এই অরণ্যকে ক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পণ করেছিলেন তুষারবাবু। তিনি বুঝেছিলেন, ম্যানগ্রোভ অরণ্যকে সংরক্ষণ করার জন্য গাছের ক্ষয় রোধ করা যেমন জরুরি, তেমনি নতুন গাছ লাগানোও সমান প্রয়োজন। গ্রামের সাধারণ মানুষকেও এই কথা বুঝিয়েছিলেন তিনি। নিজের জীবনের ৫০ বছরেরও বেশি সময় শুধু সুন্দরবন, সেখানকার মানুষ এবং ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তুষারবাবু। এগুলিকে নিছক কাজ নয়, নিজের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই মনে করেন তিনি। গড়ে তুলেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সঙ্গে নিয়েছেন বেশ কিছু সমমানসিকতার মানুষকে। এবং এই রকম নিষ্ঠা সহকারে কাজ করার জন্য ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন ভারত সরকারের তরফ থেকে পদ্মশ্রী সম্মান। ১৯০৮ সালে পেয়েছেন যমুনালাল বাজাজ পুরস্কার। লিখেছেন একটি বইও। 

          তাঁর নিজের কথায়," আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে দেখলে উন্নয়নের একটা ছাপ অতি প্রকট। রাস্তাঘাট হচ্ছে। গঞ্জগুলি চকচকে রূপ পাচ্ছে। নেশার দ্রব্যের অফুরন্ত জোগান বাড়ছে। স্কুল হচ্ছে, কলেজ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এই উন্নয়ন অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যে কোনও গরিব পাড়ায় ঢুকুন, পঞ্চাশটা বাড়িতে খোঁজ নিন, তাদের জীবন-জীবিকার উন্নতি উপর থেকে চুঁইয়ে খুবই কম নেমেছে। জন্মসূত্রে বংশপরম্পরায় এরা সব দিক থেকেই গরিব।" এই গরিবদের জন্যই কাজ করে এসেছেন তিনি। গত বেশ কয়েক দশক ধরে সুন্দরবন এবং আধুনিক সভ্যতার মাঝখানে মানবসেতু হয়ে কাজ করছেন।

   

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...