তখনও গান শোনা আজকের মতো এমন সহজ হয়নি। মোবাইলে প্লেলিস্ট আসেনি। ইন্টারনেট দুরস্ত। গান শোনায় তখন ক্যাসেট, সিডির যুগ। আর ছিল এফএম, টেলিভিশনে মিউজিক চ্যানেল। প্রতি বিকেলে তাদের কাছেই ফিরে আসা। গানকে সারাক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে রাখতে চাইলে সঙ্গী ওয়াকম্যান।
স্কুল ছুটির পর বাস ছোটে তরতরিয়ে। কানের হেডফোনে গান। নতুন এক গায়কের গান। সবে চোট খেয়েছে বয়সন্ধির মন। চিনচিনে ব্যথায় গান ঘোরে ‘তড়প তড়প কে ইস দিল সে আহ নিকালতি রহি...’
কখন যে গানের কথা নিজের কথা হয়ে ওঠে সে কথা বোঝে না কিশোর প্রেমিক। শুধু গান খুঁজে চলে আর গায়কের নাম। কেকে। কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ। দ্য কিং অফ মেলোডি।
কেকে। এক সময়ের মুখ। নব্বই দশকের গান জগতের যুগ চিহ্ন। ইন্ডিপপ প্রজন্মের প্রতিনিধি। ইলেকট্রিক গিটারের গর্জনে কাঁদাতেও পারেন আবার রাগাতেও পারেন। কিন্তু কেকে যতনা রাগী রকের তার চেয়ে অনেক বেশি কান্নার। প্রেমের। প্যাশনের। সেভাবেই তাঁকে চিনেছেন শ্রোতারা। প্রেমে, বিচ্ছেদ, বন্ধুত্ব সবেতেই মিলেমিশে গিয়েছেন।
বলিউডে পা রাখেন ১৯৯৬ সালে। সেই বছরেই ‘মাচিস’ সিনেমায় একটি ছোট্ট গান গেয়েছিলেন। অশান্ত পঞ্জাবের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ছবি। পরিচালনায় গুলজার। ঘরছাড়া যুবকদের গলা ঘরের টান খুঁজছে…‘ছোড় আয়ে হাম’। বিশাল ভরদ্বাজের লেখা। বলিউডে প্রথম গান। জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল ছবি। গানের পরিধি ছোট হলেও সে গানের জনপ্রিয়তার পরিধি মোটেই ছোট ছিল না। বড় ব্রেক পান তিনবছর পর। ছবির নাম ‘হাম দিল দে চুকে সনম’। সেই একই বছরে সোনি মিউজিক থেকে বের হয় তাঁর প্রথম সোলো গানের অ্যালবাম ‘পল’।
গোটা দেশের তরুণ প্রজন্মের মন জিতে নেন কেকে। বন্ধুত্বের গানে তিনি ‘সিগনেচার’। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেস্ট, ফেয়ারওয়েল থেকে শুরু করে বন্ধুদের রিইউনিয়ন ‘প্যার কে পল’ ছাড়া অসম্পূর্ণ।
কেকে আসলে এক ম্যাজিক। শ্রোতাদের ভাষায় মেলডি কিং। দু’দশকের লম্বা কেরিয়ার। অজস্র হিট, কিন্তু পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে মাত্র একবার। ২০০৮ সালে ‘বচনা অ্যায় হাসিনো’ ছবির ‘খুদা জানে’ গানের জন্য।
দিল্লিতে এক মালায়ালি পরিবারে জন্ম। বড় হওয়া ওঠাও দিল্লিতেই। মাউন্ট সেন্ট মেরিজ স্কুলের ছাত্র। কিরোরী মল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হন। বাণিজ্য শাখায়। মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে এক হোটেলে চাকরিও করেছিলেন আটমাস। কিশোরকুমারের অন্ধ ভক্ত কৃষ্ণকুমারের কিন্তু স্বপ্ন ছিল সুরই। সুরই নসিব, সেই টানেই কয়েক বছর পর সোজা মুম্বই। জানতেন অনিশ্চয়তা আছে সেই বাস্তবে, কিন্তু ভরসা ছিল নিজের স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্নের শরিক হয়েছিল বাবা আর স্ত্রী জ্যোতি।
প্রথাগত গানের তালিম তাঁর ছিল না। গানের স্কুলে নাম একবার লিখিয়েছিলেন, তিনি কয়েকদিন গিয়ে আর আগ্রহ পাননি ধরা বাঁধা ক্লাসে। সাহস পেয়েছিলেন প্রিয় গায়কের জীবন থেকে।
কেকে’কে আবিষ্কার করেছিলেন হরিহরণ। তাঁর গান শুনে পরামর্শ দিয়েছিলেন বোম্বাই আসার। তখন কেকে নিজেই জানতেন না একদিন মুম্বাই হয়ে উঠবে তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
গান তাঁর জীবন বদলে দিয়েছিল। সাফল্যের হরিণ ধরা দিলেও কোনওদিন লাগামছাড়া হননি তিনি। তাঁর গান যত জনপ্রিয় হয়েছে ততটাই আড়ালে থেকেছেন। তাই কেকের গান চেনা কেকের মুখ তত চেনা নয় শ্রোতার কাছে।
নিজেই একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর অনেক শোতে শ্রোতারা অনস্টেজ তাঁকে চিনতে পারেনি। প্রোগ্রাম শেষে এসে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর নিজের গলা নাকি অন্য কেউ গাইছিল!
জিঙ্গেল গেয়েছেন। টেলিসিরিজের ট্র্যাকে কণ্ঠ দিয়েছেন। বলিউডে প্লেব্যাকের পাশাপাশি বাংলা, ওড়িয়া, অহমীয়া, তামিল, মালায়ালাম, গুজরাটি বহু আঞ্চলিক ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন।
গান ছাড়া কখনও দ্বিতীয় স্বপ্ন দেখেননি। নিজের কাছের মানুষদেরও সঙ্গী করে নিয়েছিলেন সেই স্বপ্নে। তাঁর স্ত্রী তাঁর বাল্যবন্ধু প্রেমিকা। তাঁর জীবনের সব চড়াই উৎরাইয়ের সঙ্গী। কেকে কখনও বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়েননি। কাজের কঠোর দুনিয়াতেও বন্ধু খুঁজে পেয়েছেন তাই। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধু তাঁর গান।
জীবনের শেষ গানে চেয়েছিলেন কথা বলুক স্মৃতিরা। যেন জানতেন শুধু মুহূর্ত সত্যি। কলকাতায় ভিড়ে ঠাসা অডিটোয়ামে দমচাপা হৃদয়ে গেয়েছিলেন, ‘হাম রহে না রহে ইয়াদ আয়েঙ্গি ইয়ে পল’...
শিল্পী মাটির পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেলেও শিল্প থেকে যায় অক্ষয় অমরত্বে…সেভাবেই গানে গানে থেকে যাবেন কৃষ্ণকুমার কুন্নাথও…