নদীয়ার গোলাপটির চন্দ্রনাথ ঘোষ লেন। সেদিন অমাবস্যার রাত। পুজো করছেন পুরোহিত। নিয়ম, নিষ্ঠা, রীতি মেনে পুরোহিত মশাই পুজো করে চলেছেন। বাড়ির অন্য প্রান্তে হয়েছে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। পাত পেড়ে আনন্দ করে সকলে খাচ্ছেন। কেউ আবার পুজোর শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।তবেই প্রসাদ গেরহণ করবেন। নদীয়ার কৃষ্ণনগরের গোলাপটি লেনের একটি বাড়ির চিত্র এটি। বিশিষ্ট বিপ্লবী হেমন্ত সরকারের বাড়ির চিত্র। এই বাড়ির কর্তা হেমন্ত সরকার কিন্তু ওই পুজোর সময় দিব্যি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভারী নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে হেমন্তবাবুকে। তিনি দিব্যি নিজের অন্য কাজ নিয়ে মেতে রয়েছেন।
কিন্তু সরকার বাড়ির পুজোর হয়ে সমস্ত তদারকি করে বেড়াচ্ছেন এক ঝাঁকড়া চুল আর গভীর চোখসমেত মানুষ। তবে কাজ তদারকি করলেও সেই মানুষটির চোখ মাঝে-মাঝেই চলে যাচ্ছে মা কালীর মূর্তির দিকে। মনে মনে সেই মানুষটা গুনগুন করে শ্যামা সংগীত গেয়ে উঠছেন। আবার কখনো মায়ের সামনে ভক্তি ভরে প্রণাম করতে বসে পড়ছেন। কখনো আবার সব ভক্তরা ঠিকমতো খাবার পেল কিনা সেটা দেখার জন্য দৌড়চ্ছেন। অনেকেই বলছেন "আরে মানুষটা কি অপ্রকৃতস্থ?, এমন পাগলপারা মানুষ কখনো দেখেনি অনেকেই"! তবে যাঁরা ওই মানুষটিকে চেনেন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এই মানুষটা শ্যামা মায়ের ভক্তির ভাবে বিভোর। এই ভক্তিময় মানুষটির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। আসলেই নিজের উদ্যোগেই বিপ্লবী হেমন্ত সরকারের বাড়িতে এই কালীপুজো একবার করিয়েছিলেন তিনি।
১৯২৬ সালে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছিল আর্থিক সংকট। এই কথা জানতে পেরেছিলেন বিশিষ্ট বিপ্লবী হেমন্ত সরকার। কৃষ্ণনগরের উত্তর দিকে গোলাপটিতে নিজেদের বাড়িতে কবিকে সপরিবারে থাকতে দিয়েছিলেন হেমন্ত সরকার। কথিত আছে ওই বছর ওখানে কালী পূজা করেছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। লালগোলার যোগাচার্য বরদাকান্ত মজুমদারকে দিয়ে পুজো করিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেই পুজোয় ভোগের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন তিনি। সেই পুজোয় লুচি, ফুলকপি, বেগুন ভাজার ভোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় সকল বিপ্লবীরাও আমন্ত্রিত ছিলেন। শোনা যায় সেই সময়ের অনেক বিশিষ্ট বিপ্লবী ঐদিন খেতে এসেছিলেন। হেমন্ত সরকারের পরিবারের অনেক মহিলারাও এই পুজোর কাজে আনন্দে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
অজিত দাসের রচিত বই "কাজী নজরুল ইসলাম:- এক অজ্ঞাত পর্ব"বইতেও এই পুজোর প্রসঙ্গ উল্লিখিত রয়েছে। আরেকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী অনিল চক্রবর্তীও কবির এই কালীপুজোর প্রসাদ পেয়েছিলেন বলে ওই বইটিতে উল্লেখ রয়েছে।
তবে ঐতিহাসিকরা বলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই পুজোর কোন পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে ওই অঞ্চলের সকলের মুখেই কবির এই কালীপুজোর কথা শোনা গেছে। এ বিষয়ে লিখিত দলিল বলতে “কাজী নজরুল ইসলাম: এক অজ্ঞাত পর্ব” বইটির কথা বলা যেতে পারে। তবে যে সুরকার, গায়ক, লেখক-এর শ্যামা সঙ্গীতের সুরে আপামর বাঙালি রীতিমতো মজে থাকে তাঁর কালী পুজো করার তথ্যটি বিশ্বাসযোগ্য হিসেবেই ধরে নিয়েছেন ঐতিহাসিকরা।