মিঠু মুখার্জি মানেই রুপোলি পর্দার ছটফটে-চটপটে কাঙ্ক্ষিত এক নায়িকা

সাতের দশকের বাংলা ছায়াছবিতে চরিত্রের চেহারায়, চলনে-বলনে চটপটে ও ছটফটেপনা; চোখেমুখে নাগরিক বুদ্ধির দীপ্তি অনায়াসেই মেলে ধরে বিখ্যাত হয়েছিলেন মিঠু মুখার্জি। আবার তিনি যে সেই ইমেজ থেকে বেরিয়ে গ্রাম্য আটপৌরে চরিত্রে নিজেকে অনায়াসেই ঢেলে নিতে পারেন, তারও প্রমাণ দিয়েছেন। মিঠু তাঁর শেষ ছবি ‘আশ্রিতা’(১৯৯০)-তে স্বামীর অত্যাচারে ত্রস্ত গ্রাম্য-সরল-অশিক্ষিত গৃহবধূর চরিত্রটি যে অপূর্ব মুন্সিয়ানায় চিত্রিত করেছিলেন, তাতে তাঁর শক্তিশালী অভিনয়প্রতিভার বহুমুখীনতাকেই প্রমাণ করে।

মিঠু চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে আসেন মাত্র সতের বছর বয়সে। ‘শেষ পর্ব’ (১৯৭২) ছায়াছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়পর্ব শুরু। সাতের দশকের শুরুতে চিত্ত বসু পরিচালিত এই ছবিতে শমিত ভঞ্জের নায়িকারূপে তাঁর সেই নাগরিক-স্মার্টনেস চলচ্চিত্র সমালচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তবে সুখ্যাতি শুরু হয়েছিল দীনেন গুপ্তর ‘মর্জিনা আবদুল্লা’ (১৯৭৩) ছবিতে দেবরাজ রায়ের বিপরীতে বুদ্ধিমতী মর্জিনার ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ছবিটি বক্স অফিসে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে। মিঠুর অভিনয় তো বটেই ছুরি নিয়ে দস্যুদের সামনে ‘হায় হায় প্রাণ যায়’ গানে তাঁর অনবদ্য নাচ দর্শকদের মনে অদ্ভুত এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল।

১৯৭৩ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘নিশিকন্যা’ ছবিতে অভিনয় করেও বেশ প্রশংসা পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের রোমান্টিক-কমেডি ‘মৌচাক’ ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের বিপরীতে অনবদ্য অভিনয় করে একেবারে মাতিয়ে দিয়েছিলেন মিঠু। উত্তম কুমার, সাবিত্রী, রবি ঘোষ, রত্না ঘোষাল, চিন্ময় রায়, অনুপ কুমার প্রমুখের অসাধারণ অভিনয়ে সমৃদ্ধ এই ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই ছবিতে ভাড়াটে রঞ্জিতের পাশের বাড়ির মেয়ে মিঠু। নাগরিক স্মার্টনেসকে আশ্রয় করে দুষ্টু ও বুদ্ধিমতী মেয়ে নীপার চরিত্রে তাঁর অসাধারণ অভিনয় এখনও আমাদের ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয়। এ মেয়ে সেই মেয়ে, যে, ভালোবাসার মানুষটিকে দুষ্টুমির মধ্য দিয়ে নাস্তানাবুদ করে ভালোলাগার আবেগটিকে বুঝে নিয়ে নিজের ভালোবাসা বুঝিয়ে দিতে দ্বিধায় ভোগে না। হয়ে ওঠে প্রতিটি যুবকের স্বপ্নের নারী।    

পরের বছর দুটি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন মিঠু। তার মধ্যে দেবরাজ রায়ের বিপরীতে ‘কবি’ (১৯৭৫) ছবিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হলেও ছবিটি দর্শকের আনুকূল্য লাভ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। শুরু থেকে এই প্রথম ব্যরথতার মুখোমুখি হয়েছিলেন মিঠু। কিন্তু পরের ছবিটি তাঁর বাৎসরিক সাফল্যের ধারা বজায় রেখেছিল। ছবিটির নাম, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ (১৯৭৫)। ছবির পটভূমি গ্রাম হলেও মিঠুর অভিনীত চরিত্রটি দাপুটে এবং ব্যক্তিত্বময়ী। রঞ্জিত মল্লিকের বিপরীতে সেই চরিত্রে তাঁর অভিনয় আপামর দর্শকের মনে স্থায়ী একটা জায়গা করে নিয়েছিল।

১৯৭৬ সাল বাংলা ছবির জগতে মিঠুর খুব একটা ভালো কাটল না। এ-বছর তাঁর দুটো বাংলা ছবির মধ্যে দুটোই ফ্লপ করল। প্রথমটি বিজু ফুকনের বিপরীতে ‘হোটেল স্নোফক্স’, দ্বিতীয়টি সন্তু মুখোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘চাঁদের কাছাকাছি’। দুটো ছবিতেই চরিত্রাভিনেতা হিসেবে উত্তম কুমার অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু মিঠু বা উত্তম-ক্যারিসমা কোনটাই কাজ করেনি এবার। ‘কবি’ ফ্লপ করার পরই মিঠু ভেবেছিলেন যে, শুধু বাংলা ছবি নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, সর্বভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্র বলিউডে নিজের জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। এ-বছরই তাতে সুযোগও পেয়েছিলেন। অভিনয় করেছিলেন দুলাল গুহ পরিচালিত ‘খান দোস্ত’ (১৯৭৬) ছবিতে। শত্রুঘ্ন সিনহার বিপরীতে হিন্দি ছবিতে প্রথম আবির্ভাবেই সফলতা আদায় করতে পেরেছিলেন মিঠু। ১৯৭৬ সালে এটিই তাঁর একমাত্র সফল ছবি। এই ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজ কাপুর।

১৯৭৬ সাল থেকেই মিঠু বাংলা ও হিন্দি ছবিতে পাশাপাশি অভিনয় করতে শুরু করেন। কিন্তু পরের বছর থেকেই বলিউডে তাঁর ব্যর্থতার ধারা শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বিনোদ মেহরার বিপরীতে ‘সফেদ ঝুট’ ছবিতে অভিনয় করেন। কিন্তু ছবিটি ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে বাংলায় পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘প্রতিমা’ (১৯৭৭) ছবিতে তিনি ব্যাপক সাফল্যের মুখ দেখেন। তিন লাখ তিরিশ হাজার বাজেটের ছবিটি ব্যবসা করে দশ লাখ টাকার।

১৯৭৯ থেকে ৮০—এই দুটো বছর তাঁর কেরিয়ারকে খুব একটা সফলতা দিতে পারেনি। হিন্দি ছবি ‘দিল্লাগি’, ‘দো লড়কে দোনো কড়কে’; বাংলা ছবি ‘ভাগ্যচক্র’, ‘বন্ধন’, ‘সন্ধি’ প্রভৃতিতে তাঁর অভিনয় প্রশংসা পেলেও ছবিগুলো দর্শকের আনুকূল্য তেমন লাভ করতে পারেনি। ফের সাফল্যের মুখ দেখলেন ১৯৮১ সালে। ‘ফাদার’ ছবিতে অভিনয় করে। ছবিতে বোবা-কালা এক ধর্ষিতার চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করল। এই ছবিতে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে সুমিত্রা মুখার্জি ও মহুয়া রায়চৌধুরীর মতো বলিষ্ঠ অভিনেত্রীদের পাশাপাশি তিনি টক্কর দিয়ে অভিনয় করে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা আদায় করে নিলেন।

১৯৮৪ সালে অন্যের ব্যানারে ‘প্রার্থনা’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের একটি প্রযোজনা সংস্থা স্থাপন করেন মিঠু। শুরু করেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা। পরিচালক দীনেন গুপ্ত তাঁর সংস্থার হয়ে শুরু করেন ‘রাঙা ভাঙা চাঁদ’ নামে একটি ছবির শ্যুটিং। ছবির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন মিঠু। ছবির অর্ধেক শ্যুটিং হয়ে যাওয়ার পর পরিচালকের সঙ্গে তাঁর মতান্তর ও মনান্তর ঘটে। দীনেন কাজ ছেড়ে দেন। ছবি ক্যানবন্দি হয়ে পড়ে থাকে পাঁচ বছর। ১৯৮৯ সালে চন্দ্র বরোটের পরিচালনায় ছবিটি সম্পূর্ণ হয় এবং ‘আশ্রিতা’ নামে ১৯৯০ সালে মুক্তি পায়। ছবিটি শুধু যে উচ্চ প্রশংসিত হয় তাই নয়, অসম্ভব ভালো ব্যবসাও করে। তিরিশ লাখ টাকা বাজেটের ছবি তিন কোটির ব্যবসা করে। অসম্ভব সফল এই ছবিটি প্রযোজনা ও অভিনয় করে একইসঙ্গে বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্র জগতকে বিদায় জানান মিঠু মুখার্জি। তারপর থেকে এই সাতষট্টি বছরে পৌঁছে এখনও অব্দি সিলভার স্ক্রিনের মায়ায় আর ফিরে আসেননি তিনি।

আসলে, কানন দেবী, সুচিত্রা সেনের মতো মিঠু মুখার্জিও জানতেন কোথায় থামতে হয়। তাই তাঁদের মতোই দর্শকের মনের ভালোলাগা আর ভালোবাসার রেশটিকে এখনও সুন্দর স্মৃতির মতো ধরে রাখতে পেরেছেন তিনি। মিঠু সংখ্যায় খুব বেশি ছবি করেননি, কিন্তু যে-কটিতে করেছিলেন, তার বেশিরভাগ ছবিই মনে রাখার মতো, সেসব ছবিতে তাঁর অভিনয়ও তাই দর্শকের মনে স্থায়ী দাগ রেখে গিয়েছে। সাতের দশকে অনেকেই নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে এসেছিলেন, কিছু ছবিতে অভিনয় করে তাঁরাও সংসারের প্রয়োজনে অভিনয়কে বিদায় জানিয়েছেন। কিন্তু মিঠু মুখার্জি তাঁদের মতো বিস্মৃত হয়ে যাননি, তিনি দুষ্টুমিস্টি-চটপটে সদ্য যুবতী নীপা হয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার নারীরূপে নন্দিতা হয়ে রয়েছেন এখনও…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...