অরুণ চ্যাটার্জী থেকে উত্তম কুমার হয়ে ওঠার যাত্রা পথ

আজ ২৪ জুলাই। বাঙালির মহানায়কের চলে যাওয়ার দিন আজ। ৪২ বছর অতিক্রান্ত চলে গিয়েছে অরুণ চ্যাটার্জী, ইন্ডাস্ট্রি! বাঙালির রুপোলি পর্দার ম্যাটিনি আইডল, হার্টথ্রব উত্তম। আজও তাঁর স্টারডম অক্ষত। কিন্তু কেমন ছিল সেসব দিন? যখন স্ট্রাগেল করছেন মহানায়ক?

সাতকড়ি বাবুর ছেলে থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার পথ সহজ ছিল না। নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে ওঠার যাত্রায় হাজারও বাধা, বিপত্তি পেরতে হয়েছিল উত্তম কুমারকে। প্রথম জীবনে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে কেরানির চাকরি করতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ তিনি পরিবারের জেষ্ঠ্য পুত্র, নিয়ম মেনে সংসারের দায়ভার তাঁর কাঁধেই এসে পড়েছিল। বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে সেই দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন।

চাকরির সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক নাটকের দল সুহৃদ সমাজ নাট্যগোষ্ঠীতে অভিনয়ও করতেন। পরিচালক নীতিন বসু পরিচালিত 'দৃষ্টিদান' ছবি থেকে ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেছিলেন উত্তম। দৃষ্টিদান ছবিতে তিনি নায়ক অসিতবরণের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ছবির টাইটেল কার্ডে তাঁর নামই ছিল না। দ্বিতীয় কামনা থেকে তিনি নায়ক। সেখানে টাইটেল কার্ডে নাম দেখা গেল 'উত্তম চ্যাটার্জি।' ছবি চলল না। পরের ছবি মর্যাদাতে নাম নিলেন অরূপ কুমার। মুখ থুবড়ে পড়ল ছবিটি। পরের ছবি ওরে যাত্রীতে আবারও 'উত্তম চ্যাটার্জি' হয়ে ফিরলেন। পরের ছবি সহযাত্রী থেকে তিনি উত্তম কুমার নাম নিলেন। তখনও সাফল্যের অপেক্ষা।

পরিচালক নির্মল দেকে উত্তম কুমারের রুপোলি পর্দার জন্মদাতা বলা যায়। মহানায়কের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি দৃষ্টিদান থেকে সঞ্জীবনী অবধি পরপর সাতটি ছবি ফ্লপ করার পর উত্তম তখন অভিনয় ছাড়ার কথা ভাবেন। স্টুডিও পাড়ায় নাম হয়েছে ফ্লপ মাষ্টার জেনারেল, জুটছে বিদ্রুপ আর টিপ্পনি। সেই সময় নির্মল দে বসু পরিবার ছবিতে উত্তমকে নিলেন। ছবি ১৯৫২ সালে মুক্তি পেল। ঘুরে দাঁড়ালেন উত্তম। বাকিটা ইতিহাস...

তবে দৃঢ় সংকল্পী ছিলেন উত্তম। ১৯৫১ সাল, এমপি স্টুডিওতে তিনি তখন ৩০০ টাকা মাইনের চাকরি করেন। সেই সময় ওই প্রোডাকশন 'প্রত্যাবর্তন' নামে একটি ছবি তৈরি করছে। ছবির নায়ক অসিতবরণ, তিনি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করছেন। শুটিংয়ে তাঁকেই ক্যামেরা ফোকাস করছে। শটে তার সামনে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর একজন ব্যক্তি। পুরো ছবিটাতেই ওই ব্যক্তি পিছন ফিরেই রয়ে গেলেন। দর্শকরা তাঁর মুখ দেখতে পেল না। পরবর্তীকালে ওই ব্যক্তি যখন ছবিটি দেখলেন, মনে মনে অসম্ভব যন্ত্রণা পেলেন। কিন্তু তাঁর কিছু করার ছিল না। সেই দিনই তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন একদিন ক্যামেরার মুখোমুখি হবেন, তাঁর ছবি লোকে দেখবে। সেই প্রতিজ্ঞা, সেই স্বপ্ন, সেই যন্ত্রণা একদিন বাস্তবায়িত হল। তিনি অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, পোর্ট কমিশনারের সামান্য এক কেরানি অরুণ চট্টোপাধ্যায়। পায়ের তলায় এক চিলতে জমির জন্য লড়তে হয়েছে এক ভয়ঙ্কর লড়াই। অভিনয়ের নেশা আর অভিনয় ক্ষমতাকে ভর করেই ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন ফ্লপ মাস্টার তকমা।

১৯৫১তে ওরে যাত্রী, সহযাত্রী, নষ্টনীড় এবং ১৯৫২ সালে সঞ্জীবনী, কার পাপে, লাখ টাকা, নবীন যাত্রা; একের পর এক ছবি তখন চূড়ান্ত ফ্লপ। তারপর এল বসু পরিবার। নায়িকা সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, নায়কের বোনের চরিত্রে অভিনয় করলেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেলেন নতুন নায়ক। অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন উত্তম কুমার। নির্মল দে এক্ষেত্রে জহুরীর ভূমিকা পালন করলেন। তারপর মুক্তি পেল 'সাড়ে চুয়াত্তর'। ছবিটি হলো সুপারহিট। এই ছবিতে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করলেন সূচিত্রা সেন। সেই প্রথম উত্তম-সুচিত্রা জুটির জন্ম হল।

উত্তম কুমারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নিরেন লাহিড়ী, চিত্ত বসু, সুকুমার দাশগুপ্ত, মঙ্গল চক্রবর্তী, দেবকী বসু, নরেশ মিত্রর মতো পরিচালকসহ অগ্রদূত। অগ্রদূত গোষ্ঠীর অগ্নিপরীক্ষা উত্তম কুমারের কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এই ছবি থেকেই রোমান্টিক নায়ক উত্তম কুমারের জন্ম। প্রেমিক উত্তম কুমার এবং প্রেমিকা সুচিত্রা সেনের রসায়নে বাঁধা পড়ল বাঙালির মন। আর পিছন ফিরে তাকাতে হল না একসময়ের ফ্লপ মাস্টারকে।

১৯৫৫ সালে পরিচালক সুধাংশু মুখার্জির সাঁঝের প্রদীপ, সুধীর মুখার্জির শাপমোচন, মানু সেনের বিধিলিপি, অর্ধেন্দু সেনের হ্রদ উত্তমের উত্তরণের যাত্রা চড়াইয়ের পথ ধরল। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখন উত্তম কুমার নির্ভর। মৃণাল সেনের প্রথম ছবি 'রাত ভোর'-এর নায়ক হলেন উত্তম কুমার। তপন সিংহের উপহার, মানিকের নায়ক একেবারে সাফল্যের শিখরে মহানায়ক। অগ্রদূত গোষ্ঠীর সবার উপরে পথে হল দেরী। ছুটে চলেছেন উত্তম। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তার দিকে তাকিয়ে। প্রযোজক-পরিচালকরা উত্তম কুমারকে নিয়ে ছবি করার জন্য পাগল।

কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে চূড়ান্ত অসফল এক অভিনেতাকে কেন তাঁর ছবিতে নিয়েলেন নির্মল বাবু? সেই গল্প ছাড়া যে সব অক্ষত থেকে যায়। এম পি প্রোডাকশন্সের ছবি সঞ্জীবনী ছবির কাজ চলছে। উত্তম, নির্মল দে দু-জনেই তখন এম পিতে ছিলেন। সঞ্জীবনীতে অনুপম ঘটকের সুরে শৈলেন রায়ের কথায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান চাঁদের বেণু বাজবে এবার। একদিন স্টুডিওতে বসে গানটা গাইছিলেন উত্তম। কাছেই ছিলেন নির্মল দে। তাঁর কানে এল উত্তমের সুরেলা গলা আর চোখে পড়ল মুখের নাটকীয় অভিব্যক্তি ও আত্মমগ্নতার রূপ। ঠিক করলেন নিজের প্রথম পরিচালিত ছবি বসু পরিবারে বড়ভাই সুখেনের চরিত্রে কাস্ট করবেন উত্তমকে।

অনেকেই নাক সিঁটকালেন। কিন্তু নির্মলবাবু অনড়। ভাগ্যিস তিনি চিনেছিলেন সেদিন। নয়ত কাকে গর্ব করতাম? নির্মল দে তাঁর পরের দুটো ছবিতেও নায়ক হিসাবে নিয়েছিলেন উত্তমকুমারকে। দুটিই উত্তমের অভিনয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাড়ে চুয়াত্তর, যে ছবিতে প্রথম দেখা গেল উত্তম-সুচিত্রা জুটিকে। পরের ছবি চাঁপাডাঙ্গার বউ, গ্রাম্য যুবকের চরিত্রে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছিলেন উত্তম। এরপরেই বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম যুগের সূচনা হয়েছিল। যা আজও বাঙালির মনে শাশ্বত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...