মাহি, এক কবির উপাখ্যান

মহেন্দ্র সিং ধোনি, তাঁকে দেখলে কখনও এক কবির মতো মনে হয়। হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যান কখন। বাড়ির লোকেরা ছাড়া সে সময় কেউ পায় না। কিংবা রোবট। ভিতরে লুকিয়ে রাখতে পারেন সব অনুভূতি। আগ্রাসন, ক্ষত, টেনশন, উচ্ছ্বাস, যন্ত্রণা।

মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখলে আবার আধুনিক রাখালের কথা মনে পড়ে। হঠাৎ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হয়তে; বা ট্রাক্টর নিয়ে একাই নেমে পড়লেন ক্ষেতে। কিংবা অরণ্যদেব। সব হিসেবের বাইরে। নিজের হিসেব মতো হাজির হন হঠাৎ। সবাইকে চমকে নিজের মতো হারিয়ে যান। বাড়ির লোকেরাই বা কি পায়? শুনেছি, মেয়ে জিভা হওয়ার খবরটা সাক্ষী দিয়েছিলেন সুরেশ রায়নাকে। ধোনিকে বলে দেওয়ার জন্য। ধোনি তখন অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে টিমের সঙ্গে।

FotoJet (62)

মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখলে এক এক সময় এক উদাসীন বালকের মতো মনে হয়। মোবাইল রাখেন না। নিজের ইচ্ছেমতো লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বা রাখেন না। তাঁকে সবাই ইচ্ছেমতো পায় না। মনে হলে টিমবাসের ড্রাইভারকে সরিয়ে চালক হয়ে যেতে পারেন দ্বিধাহীন। কাউকে আগে না জানিয়ে নিজেই জানিয়ে দিতে পারেন অবসরের কথা। তিনবার তিনি অবসর নিলেন। কাউকে আগে থেকে বুঝতে না দিয়ে।

এই একই লোক হঠাৎ আবার প্রকাশ্যে এলে আবার রাখাল থেকে আধুনিক হয়ে এক নয়া স্টাইল স্টেটমেন্ট ঝুলিয়ে নেবেন। চুলে বা দাড়িতে। রাঁচির রাখাল মুহূর্তে পৌঁছে যেতে পারেন হলিউডি নায়কের সঙ্গে তুলনায়।

এ রকম কবি, এমন উদাসীন বালক, রাখাল, রোবট কিংবা অরণ্যদেব আমরা অনেকেই মনে মনে হতে চাই। আজীবন হতে চাই। হতে পারি না। হতে পারবও না। ধোনি পারেন এবং থেকে যান ধ্রুবতারা হয়ে। সুনীল গাভাসকরের চোখে 'ভবিষ্যতের ভারত অধিনায়ক' কে এল রাহুল, সুনীল শেঠির মেয়ে আথিয়া শেঠির প্রেমিক কে. এল. রাহুল — এমন ধোনিবাদ কি ভবিষ্যতে করে দেখানো আর সম্ভব?

ইচ্ছে হল তো টুইট করলেন। হয়তে রাফাল নিয়েই টুইট করলেন একটা। আবার হারিয়ে গেলেন কোথাও। সবাই প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে টুইট করছেন শুভেচ্ছা জানাতে। কোহলি পর্যন্ত। সেখানে ধোনি চূড়ান্ত ভ্রুক্ষেপহীন। ফেব্রুয়ারির পর তিনি টুইটারে আসেন অগস্টে। দুটো বা একটা। টুইটারে নিজের পরিচয় দিতে তিনি লেখেন, Member TEAM INDIA, Biker, Gamer, Hindi Retro Aficionado, An Absolute Pet Lover & Perennially Hungry For Chicken Butter Masala. পরিচয়টাই অন্য রকম। এখানেও চিরাচরিত গতানুগতিকতার বাইরে, রাঁচির সেই বিখ্যাত পাঁচ ঝরনাগুলোর নিজস্ব নিয়মের জলপ্রপাতের মতো। হুড্রু, দসম, জোনহা, হির্নি, পঞ্চঘাঘ। আচ্ছা, ধোনি কি বাইক নিয়ে নিরুদ্দেশে গিয়ে কোনও ঝর্নার ধারে বসে থাকেন?

অনেকে বলবেন, এ কী! তুমি ক্যাপ্টেন। একটা দল চালাও। সতীর্থদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না? কোচের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না? নির্বাচক বা বোর্ড প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন না নিয়মিত? কর্পোরেট হলে যে এখন চাকরিই থাকত না তোমার। সেখানে হোয়াটসঅ্যাপেই মিনিটে মিনিটে নির্দেশ। এক মিনিট না দেখলেই তুমি এখন পিছিয়ে যাবে কাজের জায়গায়। তুমি ছাঁটাই, ভাই, নমস্কার। এ বার আসতে পারো।

সন্ধ্যারাতের ক্যাপ্টেন ধোনি এ সবের বাইরেই থেকে গেলেন আজীবন। নিজস্ব শর্তে জীবন যাপনের কিপার হয়ে। সন্ধ্যারাতের কবি হয়ে।

ভাগ্যিস, বাইরে থাকলেন। নইলে বোঝা যেত না, কী রকম ভাবে আসলে জীবনে বেঁচে থাকা যেত। কী রকম ভাবে বেঁচে থাকা হল না।

মাহি কীর্তি

১৯৮১ সালের ৭ জুলাই ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের রাজধানী রাঁচিতে জন্মগ্রহণ করেন মাহি।  ২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ২৩ বছর বয়সে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় ধোনির। সেই সিরিজে জ্বলে উঠতে না পারলেও পরের বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে সুযোগ পেয়েই করেন সেঞ্চুরি। এরপর কেরিয়ারে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ক্যাপ্টেন কুল উইকেটরক্ষক এই ব্যাটসম্যানকে।

FotoJet (63)

দেশের হয়ে তিনি জেতেননি এমন কোনও শিরোপা নেই। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েই ভারতকে এনে দেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা। তাঁর অধীনেই টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে ভারত। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে অধিনায়ক হিসেবে জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ২০১১ সালে বিশ্বকাপে ভারতকে দ্বিতীয়বার বিশ্ব জয়ের স্বাদ দেন এমএসডি। বিশ্বের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে আইসিসি অনুমোদিত সবকটি ট্রফি জেতার নজির রয়েছে তার। আইপিএলেও সফল ধোনি। অধিনায়ক হিসেবে চেন্নাই সুপার কিংসকে তিনবার শিরোপা এনে দিয়েছেন তিনি। ধোনির নেতৃত্বে আইপিএল’র ইতিহাসে আটবার ফাইনাল খেলেছে সিএসকে। 

তামাম ক্রিকেটপ্রেমী থেকে শুরু করে ধোনির সতীর্থরা তো বটেই, এমনকী অনেক সিনিয়রও বলেছেন যে, ধোনি আরও আগে অর্থাৎ ৪ বা ৩ নম্বরে ব্যাট করতে এলে অনেক ধুরন্ধর ব্যাটসম্যানের রেকর্ড এতদিনে ছাপিয়ে যেতেন। কিন্তু এহেন ধোনির কাছে দল আগে। ৩, ৪, ৫ নম্বরেও বহুবারই তিনি ব্যাট করেছেন। তবে তাঁর সব থেকে পছন্দের ব্যাটিং পজিশন ৬। এই ৬ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ধোনি এখনও অবধি ১২৯টি ইনিংস খেলেছেন। ৪৭.৩২ গড়ে রান করেছেন ৪১৬২। ৩০০৬ রান নিয়ে তাঁর ঠিক পরেই রয়েছেন অজিদের প্রাক্তন ব্যাটসম্যান মাইকেল বেভান। ইংল্যান্ডের জস বাটলার ৬ নম্বরে ব্যাট করে ১৯৭৭ রান করেছেন। বাটলার রয়েছেন তিন নম্বরে।

এখনও অবধি ১১ বার আইপিএল-এ চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আর তার মধ্যে ৮ বারই চেন্নাই সুপার কিংস ফাইনালে উঠেছে। আইপিএল  ইতিহাসে যা এক কথায় রেকর্ড। আজ অবধি কোনও অধিনায়ক টানা দশ বার আইপিএল -এ অধিনায়কত্ব তো করেনইনি, ফাইনালে ওঠা যে বহু দূর কা বাত! অন্য দিকে যে ৮টি ফাইনাল চেন্নাই সুপার কিংস খেলেছে, তার মধ্যে ৩ বার তারা জয়ের মুখ দেখেছে আর ৫ বার বিপক্ষ দলের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছে।

​উইকেটরক্ষক হিসেবে দ্রুততম স্টাম্পিংয়ের রেকর্ড -

এম এস ধোনিই বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার যাঁর গ্লাভস, বলের গতির থেকেও দ্রুত বল ধরতে সক্ষম। বিশ্বসেরা উইকেটকিপার যাঁরা রয়েছেন মানে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, কুমার সাঙ্গাকারা-- প্রত্যেকে এই চরম সত্যটি মেনে নিয়েছেন অকপটেই। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে রবীন্দ্র জাডেজা বল করেছিলেন। অজিদের তাবড় ব্যাটসম্যান জর্জ বেইলিকে সেদিন মাত্র ০.০৮ সেকেন্ডের মাথায় স্টাম্পিংয়ে আউট করেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। আজ অবধি ক্রিকেট ইতিহাসে এত দ্রুততার সঙ্গে কোনও স্টাম্পিং হয়নি।

FotoJet (64)

​সবথেকে বেশি স্টাম্পিংয়ে আউট করার রেকর্ড -

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এহেন মাহি! আখ্যা ক্রিকেটমহল যখন তাঁর অধিনায়কত্বের প্রশংসা করে, তখন ঢাকা পড়ে যায় তাঁর ব্যাটিং। আবার কেউ যখন তাঁর ব্যাটিং নিয়ে কথা বলেন, তখন আবার উহ্য থেকে যায় মহেন্দ্র সিং ধোনির উইকেটকিপিং। বিশেষ করে স্পিনারদের বোলিংয়ের সময়ে তাঁর উইকেটকিপিং এক কথায় লাজবাব। স্টাম্পিং তাঁর হাত থেকে কখনও ফস্কায় না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ারে ১৯৫ বার স্টাম্পিংয়ে আউট করার নজির দেখিয়েছেন ধোনি। আজ অবধি এই রেকর্ডের নিরিখে ধোনির ধারেকাছে কেউ নেই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...