‘বলরাজ দত্ত’ থেকে সিনেমাপাড়ার ‘সুনীল’

সালটা ১৯৮৮। বিশ্ব শান্তির বার্তা দিতে জাপানের হিরোশিমা থেকে নাগাসাকি হাঁটলেন এক ভারতীয় অভিনেতা। শান্তি চাই, ভাল থাকতে চায় পৃথিবী। এই ছিল তাঁর বক্তব্য। গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ কুর্নিশ জানিয়েছিল তাঁকে।

নাম তাঁর বলরাজ দত্ত। ছবির দুনিয়ার সুনীল দত্ত। প্রায় চার দশকেরও বেশি অভিনয় জীবন। ১৯৫৫ তে প্রবেশ করেছিলেন হিন্দি ছবির জগতে। ছবির নাম রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম।

ভারত-পাকিস্তানের অশান্তি চলছে। বলরাজ পড়ে গেলেন দাঙ্গার মধ্যে। জেকব নামে এক ভদ্রলোক তাঁর প্রাণ বাঁচালেন। সুনীল তখন সবে আঠারো।

আজীবন মনে রেখেছিলেন তাঁর কথা।হিংসার জ্বলন্ত মুখটাও আজীবন ভুলতে পারেননি। তাই বিপর্যস্ত জাপানের মাটিতে তাঁকে ওভাবে দেখা গিয়েছিল।

কেরিয়ার শুরু করেছিলেন আরজে হিসেবে। সেলিব্রিটিদের ইন্টারভিউ নিতেন। একবার স্টেশনে এলেন নার্গিস। শুনলে অবাক হবেন, শেষপর্যন্ত বাতিল হয়ে গিয়েছিল সেই ইন্টারভিউ! চোখের সামনে নার্গিসকে দেখে এমন নার্ভাস হয়ে গিয়েছেন আরজে সুনীল যে মুখ থেকে একটা কথাও সরেনি!

sunil-1

অলক্ষ্যে হেসেছিলেন বিধাতা! সেদিন কেউ ভাবতে পেরেছিল একদিন এক সূত্রে বাঁধা পড়বেন তাঁরা!

রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফ দুই সুনীলই দুরন্ত। পর্দার ভোলেকে কেউ ভুলতে পারেনি। তেমনি প্রেমিক সুনীল আর বাবা সুনীল দুজনের জার্নিই মনে রেখেছে মানুষ। আর তিনি নিজে মনে রেখেছিলেন জীবন শুরুর স্ট্রাগল। আচমকাই কীভাবে বদলে গিয়েছিল জীবন। দেশভাগ বড় লম্বা ছায়া ফেলেছিল তাঁর জীবনে। সেই ছায়াপথ ধরেই যেন ঝিলামের ‘বলরাজ’ থেকে মায়ানগরীর ‘সুনীল’ হয়ে ওঠা। ধাপে ধাপে।

১৯২৯-এর ২৬ জুন পাকিস্তানের ঝিলাম শহরে তাঁর জন্ম। বাবা দেওয়ান রঘুনাথ দত্ত। বাবাকে খুব বেশিদিন পাননি জীবনে। মায়ের কাছেই বড় হয়ে ওঠা। মা আর ছেলের জীবনে ভরসা দেওয়ার তেমন কেউ ছিল না। এসবের মাঝেই দেশভাগের অস্থিরতা। ছাড়তে হল পূর্ব পুরুষের ভিটে। এক ভূম থেকে আর এক ভূমে যাওয়ার মধ্যেই বলরাজের পরিবার আশ্রয় নিল ঝিলামের রিফিউজি ক্যাম্পে। উদ্বাস্তু শিবিরে সহজে আশ্রয় মেলে না। কাকা মেহতা হংসরাজ ছিবার পাহাড় পেরিয়ে তাদের ফেলে আসা গ্রামের বাইরে বলরাজের বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন যাতে কোনও একটা ব্যবস্থা হয়। শেষ পর্যন্ত শিবিরে জায়গা মিলল।

বলরাজ তখন লখনউতে। কলেজ ছাত্র। খবর পেলেন পরিবারের ভিটেহারা হওয়ার। তার তখন উন্মাদ অবস্থা। শিবিরে শিবিরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মা আর পরিবারকে।

শেষ পর্যন্ত আম্বালা স্টেশনে দেখা হয়ে গেল এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তার সাহাজ্যেই খোঁজ পেলেন পরিবারের। দেখা হল মা আর ভাইয়ের সঙ্গে। চেনা জীবনটা যেন রাতারাতি বদলে গেল। কাঁধে তখন অনেক দায়িত্ব। সংসারের দায়।

আম্বালাতেই মা, কাকা আর ভাইয়ের সঙ্গে শুরু হল নতুন জীবন। সেনাবাহিনীতে চাকরি নিলেন বলরাজ। যোগ দিলেন হাবিলদার পদে। প্রায় এক বছর চলেছিল সেই চাকরি।১৯৪৭-এর পর সিভিলিয়ান ক্লার্কের পদে।

১৯৫০ নাগাদ কিছুটা যেন ঠিক হল পরিস্থিতি। আবার ফিরলেন কলেজজীবনে। হিন্দ কলেজে ভর্তি হলেন ছাত্র হিসেবে। দিনে কলেজ, রাতে চাকরি। কার্লায় এক কামরায় একটা ছোট্ট ঘরে থাকতেন। কলেজে থাকতে থাকতেই আরও এক নতুন স্বাদ পেলেন। ছবি আর অভিনয় খুব টানত। কণ্ঠস্বরের জন্য ডাক আসত। কিন্তু এত দায়িত্ব সামলে সেপথে এগোন খুব সহজ নয়। একবার সুযোগ এল চাকরিবদলের। নামকরা ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডিজে কিমারের ডাক। সেই চাকরিতে যোগ দিলেন। রেডিয়ো সিলনের ব্রডকাস্ট বিভাগে যোগ দিলেন। তিনি এবার আরজে। মোড় ঘুরে গেল জীবনের…সঙ্গী হৃদয়।  

sunil-2

লম্বা চওড়া পাঠান পুরুষ বলরাজের হৃদয়ের ঘরটাও ছিল তেমন বড় মাপের। সে ঘর কোনওদিন বদলাতে দেননি তিনি। জীবনে সাফল্য এসেছে। প্রাচুর্য্য এসেছে। মসৃণ হয়েছে চলার পথ, কিন্তু হৃদয় দফতরবদল করেনি কোনওদিন। তাই আদর্শ পুত্র থেকে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন আদর্শ পিতা। অভিনেতা হিসেবে যতটা সৎ ততটাই সৎ নিজের আবেগের কাছে। সেভাবেই তাঁকে মনে রেখেছে সমকাল…   

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...