বন্ধু বটুকেশ্বর দত্ত ভগৎ সিংকে পড়ে শোনাতেন নজরুলের কবিতা

সন ১৯২৯। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। চৈত্র শেষের মুখে। বৈশাখী হাওয়ার গরম ঝাপট লাগতে শুরু করেছে ভারতবাসীর চোখে মুখে। তাত বাড়ছে বাতাসের, সেই সঙ্গে এদেশের আবহাওয়ারও।

ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ৮ এপ্রিল। অধিবেশন শুরু হয়েছে দিল্লিতে সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি হাউসে। ফুটছে জনতা। সেদিন হাউসে পাশ হবে সেফটি ও ট্রেড ডিসপুট বিল।

দর্শকাসনে ছদ্মবেশে চুপচাপ বসে গেলেন তাঁরা। ভিতরের উত্তেজনাটাকে সংযমের বর্মে চাপা দিয়ে নির্লিপ্তভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন সভা শুরুর।

যথা সময়ে শুরু হল অধিবেশন। দমনমূলক এই বিল পাশ করাতে বদ্ধ পরিকর ব্রিটিশরা। স্পিকারের আসনে বিঠলভাই প্যাটেল।আলোচনা আর কথায় সভা যখন বেশ সরগরম, ভোটের ফল ঘোষণা করতে যাবেন স্পিকার, তখন আচমকা বিস্ফোরণ! ধোঁয়ায় ধোঁয়া ঘর! হাত গর্জে উঠল দুই বিপ্লবীর হাত। দেশ মায়ের নামে কসম খেয়ে এসেছেন তাঁরা। এ সভা চলতে দেওয়া যায় না! বন্দে মাতরম ধ্বনিতে মুখর কণ্ঠ।

মুহূর্তে মধ্যে সশস্ত্র উর্দিধারীতে ছয়লাপ গোটা চত্বর। ওঁরা কিন্তু পালালেন না। ধরা দিলেন। ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত। গ্রেফতার হলেন সংসদ হামলার অভিযোগে।

ভগৎ সিং আজও মুখর ভারতবাসীর চেতনায়। পঞ্চনদীর দেশ থেকে আসমুদ্র হিমাচলে তিনি জেগে, কিন্তু দেশ ভুলেছে তাঁর সহযোগীকে। যাঁকে ছাড়া এই অভিযান সম্পূর্ণ হত না। বাংলার বটুকেশ্বর। দলের ‘মোহন’।

বর্ধমানের খণ্ডঘোষের ওয়ারি গ্রামে জন্ম। ১৯১০ সালের ১৮ নভেম্বর। বাবা  গোষ্ঠবিহারী দত্ত ছিলেন রেল চাকুরে। মা কামিনী দেবী। বাবার চাকরি ছিল উত্তর প্রদেশের কানপুরে। সেখানেই কেটেছে তাঁর ছোটবেলা। প্রথমে থিওসফিক্যাল স্কুল তারপর পৃথ্বীনাথ হাইস্কুলে পড়াশোনা।

তখন বিশের দশক চলছে। জোরদার হচ্ছে স্বাধীনতার লড়াই। সর্বস্য পণ করে দেশের মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপ দিচ্ছেন দেশের নবীন প্রজন্ম।

কৈশোর থেকেই বটুকেশ্বর ছিলেন অন্যরকম। খবরের কাগজে নিয়মিত স্বদেশী আন্দোলনের খবর পড়তেন। চারপাষে ঘটে চলা ঘটনাকে বুঝতে চাইতেন যুক্তির নিরিখে। একটা ঘটনায় মোড় ঘুরে গেল জীবনের। তখনও তিনি ছাত্র। একদিন হেঁটে আসছেন কানপুরের ম্যাল রোড ধরে। দেখলেন গোরা পুলিশ বেধড়ক পেটাচ্ছে একটি বাচ্চা ছেলেকে। ভারতীয় বলে কুৎসিত ভাষায় গালি গালাজও করছে। একটি সংরক্ষিত রাস্তায় নিষিদ্ধ ছিল ভারতীয়দের চলাচল। সেই রাস্তায় ঢুকে পড়েছিল ছেলেটি। সেই অপরাধে রক্তাক্ত হতে হয় তাকে। নিজের জন্মভূমি, দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বহিরাগত বিদেশির হাতে এমন লাঞ্ছনা দেখে ঘটনায় ঘেন্নায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলেন। গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল ঘটনা।       

বটুকেশ্বর তখন কানপুর কলেজে পড়ছেন। ‘প্রতাপ’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের সূত্রে আলাপ হল শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সঙ্গে। তিনি হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়নের সহ প্রতিষ্ঠাতা। রাসবিহারী বসুর অনুগামী। ১৯১৫-তে দেশ ছাড়ার আগে রাসবিহারী বসু তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছিলেন সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার উত্তরাধিকার। তাঁকে জাহাজে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন।

রাসবিহারী বসুকে দেশের বাইরে আত্মগোপন করে থাকতে হলেও শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কিন্তু তাঁর মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গীতেই সংগঠন চালাচ্ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের পন্থা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ হয় মহাত্না গান্ধীর।  সেই বির্তক প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকার পাতায়।

কানপুরের কলেজ পড়ুয়া বটুকেশ্বর লেখা পড়ে শচীন সান্যালের ভাবনার সমর্থক হয়ে পড়েন। পরে পরিচয় ঘটে। সদ্য যুবক বটুকেশ্বরকে সংগঠনের কাজে টেনে নেন। গড়ে তোলেন মুক্তিপথের যোদ্ধা হিসেবে। এই পর্ব যখন চলছে তখন পঞ্জাব থেকে কানপুরে এলেন শচীন্দ্রনাথ সান্যালের আর এক অনুগামী ভগৎ সিং। আলাপ হল দুজনের।

ভগৎ সিং-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ঘটনা। সালটা ১৯২৪। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল কানপুরে। বন্যায় বিপর্যস্ত মানুষের সাহাজ্যের জন্য গড়া হয়েছিল ‘তরুণ সংঘ’। সেই উদ্যোগে সামিল ছিলেন পঞ্জাবের ভগৎ আর বাংলার বটুকেশ্বর। দুজনেরই স্বপ্ন এক। পথ এক। ত্রাণের কাজ করতে করতেই খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল দুজনের।

পরে সেই স্মৃতিতে বটুকেশ্বর দত্ত লিখেছেন,

“আমাদের কাজ দেওয়া হয়েছিল একই সঙ্গে। গঙ্গার পাড়ে লণ্ঠন হাতে দুজনে সারারাত পাহারায়। নদীতে ভেসে যাওয়া মানুষগুলোকে যাতে পাড়ে টেনে তুলতে পারে...”

ভগৎ সিংকে বাংলা বুঝতে সাহায্য করতেন। পড়ে শোনাতেন কাজী নজরুলের কবিতা। যা নাকি শোনা যেত ভগতের মুখে।

চন্দ্রশেখর আজাদের হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়নের সদস্যপদ গ্রহণ করেন বটুকেশ্বর দত্ত। ১৯২৫- এ কাকোরি ষড়যন্ত্রের পর নেতাদের গ্রেফতারের কারণে ধাক্কা লাগে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়নের সংগঠনে। সেই সময় বটুকেশ্বর প্রথমে বিহার এবং পরে কলকাতা চলে আসেন সংগঠনকে পোক্ত করার কাজে।

কানপুরে বড় হয়ে ওঠার কারণে ভীষণ ভাল হিন্দি বলতে পারতেন। কলকাতায় হিন্দিভাষী শ্রমিকদের মধ্যে মতপ্রচার ও সংযোগ গড়ে তুলতে তাঁকে কাজে লাগালো দল। লিফলেট ও পোস্টার লিখতেন। শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করা হত।

আবার সংগঠনকে নতুনভাবে গড়ে তোলার মতো রসদ জোগাড়ের পর ১৯২৭ সালে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন নাম বদলে হল হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন।

১৯২৮ সাল। সাইমন কমিশন নিয়ে তুঁষের আগুনের মতো রোষ জ্বলছে সাধারণ মানুষের মনে। প্রতিবাদ প্রতিরোধে মিছিল চলছে দেশে। সেই আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল মিছিলে পুলিশি আক্রমণে লালা লাজপত রাই-এর মৃত্যুর ঘটনা। উত্তাল হয়ে উঠল পঞ্জাব। ভূমিপুত্রের এমন মৃত্যু তারা সহজে মেনে নেবে না। ভগৎ সিং আর বন্ধু বটুকেশ্বর পুলিশ সুপার জেমস স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের আঘাতে মৃত্যু হল জেমসের সহকারী সুপার জন স্যান্ডার্স-এর। ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করল পুলিশ। গা ঢাকা দিয়ে বাংলায় চলে এলেন বটুকেশ্বর।

বর্ধমানের ওয়ারি গ্রামে বটুকেশ্বর আত্মগোপন করে রইলেন নগেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে। তবে চুপচাপ বসে থাকলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই দোতলার ছোট্ট মাটির বাড়ি হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের অগ্নিকুন্ড। এখানে বসেই পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করেছিলেন দুই বিপ্লবী। বাড়ির ভিতর একটি ঘরে গড়া হয়েছিল সুড়ঙ্গ।

কী ছিল তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ?

এই আত্মগোপন পর্বেই কার্যত স্থির হয়ে গিয়েছিল পার্লামেন্ট আক্রমণের কর্মসূচী। সেই পরিকল্পনার ফলাফল ১৯২৯-এর পার্লামেন্টের উপরোক্ত দৃশ্যটি।

ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। তবে তাঁদের কর্মকান্ড প্রবল আলোড়ন ফেলেছিল দেশজুড়ে। ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বরকে গ্রেফতার করা হয়। রাজপথ হোক বা কারাগার, বিপ্লবী সবসময় বিপ্লবীই। সেলুলার জেলে রাজবন্দীদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন তাঁরা। ১১৪ দিন চলেছিল অনশন। এই প্রতিবাদে সামিল বিপ্লবী যতীন দাসের মৃত্যু হয়। দাবী আদায়ে সফল হয়েছিলেন তাঁরা।

১৯৩১-এর ২৩ মার্চ ফাঁসি হয় ভগৎ সিং-এর।

 

 বটুকেশ্বর দত্ত আন্দামানে। সেখান থেকে ১৯৩৭-এ আসেন হাজারিবাগ জেল। দিল্লি জেল, শেষ পাটনা জেল। ১৯৩৮-এর সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান বটুকেশ্বর দত্ত। কিন্তু বাংলা-পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশে নিষিদ্ধ হয় তাঁর প্রবেশ। শর্ত দেওয়া হয় আর কখনও আন্দোলন ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত হতে পারবেন না তিনি।

ফিরলেন যখন তখন জেলে নির্যাতনে শরীর ভেঙেছে। কিন্তু ততদিনে যে রক্তে নিঃশ্বাসে মিশেছে বিপ্লব, তাই ১৯৪২-এ ফের জড়িয়ে পড়লেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। আবার গ্রেফতার। এবার যখন মুক্তি পেলেন তখন ব্রিটিশমুক্ত হয়েছে দেশ। মিলেছে স্বাধীনতা। জীবনের ১৮ বসন্ত কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকারে। অত্যাচারে শরীর ঝাঁঝরা। আক্রান্ত হয়েছিলেন যক্ষা রোগে।

১৯৩৭-এ বিয়ে করেন দীর্ঘদিনের আন্দোলন সঙ্গী অঞ্জলি দত্তকে। কন্যা ভারতী বাগচী।

শেষ দফা মুক্তির পর সক্রিয় রাজনীতি ও আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। মন দিয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের চর্চায়। প্রচন্ড দারিদ্রের মুখে পড়েন। সিগারেট কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। কখনও পরিবহন ব্যবসা। সব উপায়ে চেষ্টা করেন দু’ বেলা দুমুঠো সংস্থানের জন্য। বিহারে চারমাসের জন্য লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হয়েছিলেন।

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভর্তি ছিলেন দিল্লির এইমস হাসপাতালে। এই দেশ তাঁকে ভুলেছিল। কিন্তু ভোলেনি এক মা। ভগৎ সিং-এর মা বিদ্যাবতী দেবী। ছেলেকে হারিয়েছিলেন ফাঁসির মঞ্চে। তার বন্ধুটি বেঁচে ফিরেছিল। পুত্রসময় স্নেহ করতেন। তাই ৮৫ বছর বয়সী বিপ্লবী জননী রোগশয্যায় এসে বসতেন শিয়রে। শেষদিন পর্যন্ত অন্যথা হয়নি।

বটুকেশ্বর স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আরও এক স্বপ্ন বুকের মধ্যে লালন করতেন তিনি। পঞ্চনদের দেশে হুসনেওয়ালায় তাঁর বন্ধুর দেশের মাটিতে শেষ শয্যা হোক তাঁর। যে মাটিতে মিশেছে শহীদ ভগৎ সিং, রাজগুরু আর শুকদেবের দেহ।

পঞ্জাবের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সম্মান দিয়েছিলেন তাঁর সেই ইচ্ছের। প্রয়াণের পর দিল্লি থেকে পঞ্জাব নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর নশ্বর দেহ।

বহু রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে, দেশ ভাগের চড়াদামে স্বাধীন হয়েছে জননী ভারতবর্ষ। স্বাধীনতার ইতিহাস পড়া হয় বইয়ের পাতায়। বিপ্লবী আর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণ করে প্রতি বিশেষ দিনে। তাঁদের জন্য রাস্তার নামকরণ হয়, মূর্তি বসে। বটুকেশ্বর দত্তের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন দিল্লির বিকে দত্ত কলোনি নামকরণ তাঁর নামেই। আর বাংলার বর্ধমান স্মৃতি আগলে রেখেছে তাঁর।

তথ্য সূত্রঃ দ্য ওয়ার

দ্য প্রিন্ট

    

 

  

 

 

 

   

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...