“বেয়ান যেরকম আবীরটা খেলেছেন, আমি থাকলে বড় সহজে ছাড়া পেতুম না দেখচি- কালী মাখাবার লোক তাঁর আরো একটি বাড়ত।” প্রতিমা দেবীকে একটি চিঠিতে এমনটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর একটি চিঠি ছিল এরকম-“পাঁজিতে দেখলুম ১১ই চৈত্রে দোলপূর্ণিমা।আর তো দেরি নেই- এবারে তোমাদের উৎসব থেকে বঞ্চিত হলুম।” দূর বিদেশে বসে বসন্তদিনটির কথা ভুলতে পারেননি কবি। আসলে রবীন্দ্রনাথ তো প্রকৃতির কবি। চৈত্রদিনের শান্তিনিকেতনে যখন স্থলেজলে বনতলে দোলের মাতন লাগে, যখন তিথির পরে তিথির ঘাটে, আসিছে তরী দোলের নাটে, যখন উৎসবের পসরা নিয়ে শুক্লরাতে পূর্ণিমার কূলে ভেসে আসে চাঁদের তন্দ্রাহরণী তরণী তখন যে আনন্দে ভরে ওঠে নিখিল ভুবন রবীন্দ্রনাথ সেই আনন্দের কবি।
তিনি সেই বসন্তের সুর শুনিয়েছেন যে বসন্তে ধরার চিত্ত উতলা হয়, দিগন্তের কোলে কোলে দোলে আনন্দেরই ছবি, আবার সেই বসন্তদিনই আবার জনমভরা অতল ব্যথাকেও দুলিয়ে দেয়। ফোঁটা ফুলের পাশে ঝরা ফুলের ছবি যে বসন্তদিনেরই ছবি সে কথা বারবার বলেছেন কবি। আর সেই বসন্তের পূর্ণিমায় বেজে ওঠে দোলের সুর। গানে গানে বসন্তপূর্ণিমা যাপনের এই ছবি রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের সৌজন্যে বাঙালির নিতান্ত চেনা। যদিও প্রথম দিকে শ্রীপঞ্চমীতে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব করা হত। নিরাভরণ স্নিগ্ধ পরিবেশে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ব্রাহ্ম আবহ সত্ত্বেও অন্তত একবার অলক্ষ্য নয় লেগেছিল প্রত্যক্ষ রং। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় আছে, “একদিন আমাদের বারান্ডার আড্ডায় কথা উঠিল- সেকালে কেমন ‘বসন্ত-উৎসব’ হইত। আমি বলিলাম- 'এসো না, আমরাও একদিন সেকেলে ধরণে ‘বসন্ত- উৎসব’ করি। অমনি গুণুদাদার কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল। এক বসন্তসন্ধ্যায় সমস্ত উদ্যান বিবিধ রঙীন আলোকে আলোকিত হইয়া নন্দনকাননে পরিণত হইয়া উঠিল। পিচকারি, আবীর, কুঙ্কুম প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম উপস্থিত হইয়া গেল। খুব আবীর খেলা হইতে লাগিল। তারপর গান বাজনা আমোদ প্রমোদও কিছুমাত্র বাদ গেল না।”
এই উপলক্ষেই স্বর্ণকুমারী দেবী লিখলেন ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্য। হল অভিনয়ও। ঠিক দোলের দিন এই অনুষ্ঠান হয়েছিল বলে মনে হয় না। তবে এর আমেজ সম্পূর্ণত দোলের। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী প্রমুখ রবীন্দ্রনাথের গুরুজনেরা অনেকেই এই আনন্দের শরিক হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে থাকায় যোগ দিতে পারেননি। এই ‘বসন্ত উৎসব’-এ নায়িকা লীলা সেজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান আর সন্ন্যাসিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন স্বর্ণকুমারী স্বয়ং। নায়কের ভূমিকায় ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। পরবর্তী সময়ে ও ‘বসন্ত- উৎসব’ অভিনীত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথও অভিনয় করেছেন।
দোল খেলার চিরাচরিত রীতিটি বজায় ছিল জোড়াসাঁকোর ৫ নং বাড়িতে। সে বাড়িতে অবশ্য সাবেক হিন্দু পরিবারের সব আনন্দ- উৎসবই পালন করা হত। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, “দোতলায় বাবামশায়ের বৈঠকখানায়ও হোলির উৎসব হত। সেখানে যাবার হুকুম ছিল না। উঁকিঝুঁকি মারতুম এদিক- ওদিক থেকে। আধ হাত উঁচু আবীরের ফরাশ। তার উপরে পাতলা কাপড় বিছানো। তলা থেকে লাল আভা ফুটে বের হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব এসেছেন অনেক-অক্ষয়বাবু তানপুরা হাতে বসে। শ্যামসুন্দরও আছেন। ঘরে ফুলের ছড়াছড়ি। বাবামশায়ের সামনে গোলাপজলের পিচকারি, কাচের গড়গড়া, তাতে গোলাপজলে গোলাপের পাপড়ি মেশানো, নলে টান দিলেই জলে পাপড়িগুলো ওঠানামা করে। সেবার এক নাচিয়ে এল। ঘরের মাঝখানে নন্দফরাশ এনে রাখলে মস্ত বড় একটি আলোর ডুম। নাচিয়ে ডুমটি ঘুরে ঘুরে নেচে গেল।নাচ শেষ হল, পায়ের তলায় একটি আল্পনার পদ্ম আঁকা।”
অভিজাতদের এই দোল উদযাপনের পাশেই ছিল আর এক ধরণের দোলযাত্রা, আমজনতার দোল- “হোলির দিনে এই দেউড়ি গমগম করত, লালে লাল হয়ে যেত মনোহর সিং- এর সাদা দাড়ি পর্যন্ত। ওই একটি দিন তার দাড়িতে হাত দিতে পেতুম আবীর মাখাতে গিয়ে। সেদিন আর সে ধেয়ে আসত না। একদিকে হত সিদ্ধি গোলা, প্রকান্ড পাত্রে কয়েকজন সিদ্ধি ঘুঁটছে তো ঘুঁটছেই। ঢোল বাজছে গামুর গুমুর “হোলি হ্যায় হোলি হ্যায়” আর আবীর উড়ছে। দেয়ালে ঝুলোনো থাকত ঢোল, হোলির দু – চারদিন আগে তা নামানো হত। বাবামশায়েরও ছিল একটি সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া লালসুতোয় বাঁধা-আগে থেকেই ঢোলে কি সব মাখিয়ে ঢোল তৈরি করে বাবামশায়ের ঢোল যেত বৈঠকখানায়, দরোয়ানদের ঢোল থাকত দেউড়িতেই। হোলির দিন ভোরবেলা থেকে সেই ঢোল গুরুগম্ভীর স্বরে বেজে উঠত, গানও কি সব গাইত, কিন্তু থেকে থেকে ওই “হোরি হ্যায় হোরি হ্যায়” শব্দ উঠত। বেহারাদেরও সেদিন ঢোল বাজত; গান হত “খচমচ খচমচ”, যেন চড়াইপাখি কিচির কিচির করছে। আর দরোয়ানদের ছিল মেঘগর্জন, বোঝা যেত যে, হ্যাঁ, রাজপুত-পাহাড়ীদের আভিজাত্য আছে তাতে। নাচও হত দেউড়িতে। কোত্থেকে রাজপুতানী নিয়ে আসত, সে নাচত। বেশ ভদ্ররকমের নাচ। আমরাও দেখতুম। বেহারাদের নাচ হত, পুরুষরাই মেয়ে সেজে নাচত। সে কী রকম অদ্ভুত বীভৎস ভঙ্গী। দু হাত তুলে দু বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধেই ধেই নাচ আর ওই এক খচমচ খচমচ শব্দ। উড়েরাও নাচত সেদিন দক্ষিণের বাগানে লাঠি খেলতে খেলতে। বেশ লাগত।”
একদিকে বনেদীয়ানা অন্যদিকে সাধারণদের প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস-“বৈঠকখানা আর দেউড়ির উৎসব, এ দুটোর মধ্যে আমার লাগত ভালো রাজপুত দরোয়ানদের উৎসবটাই। বৈঠকখানার শখের দোল, শৌখিনতার চূড়ান্ত- সেখানে লটকনে ছোপানো গোলাপী চাদর, আতর, গোলাপ, নাচ, গান, আলো, ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু সত্যি দোল- উৎসব করত দরোয়ানরাই- উদ্দন্ড উৎসব, সব লাল চেনবার জো নেই। সিদ্ধি খেয়ে চোখ দুটো পর্যন্ত সবার লাল। দেখলেই মনে হতো হোলিখেলা এদেরই।” আরও একরকমের দোল হত ৫ নং জোড়াসাঁকো বাড়িতে। সে ছিল ছোটদের আনন্দময় রং খেলার দোল। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় তার ছবিটি এরকম-“……. আমাদের জন্য আসত টিনের পিচকারি। ওইতেই আনন্দ। টিনের বালতিভরা লাল জলে ডুবিয়ে যাকে পাচ্ছি পিচকারি দিয়ে রং ছিটিয়ে দিচ্ছি আর তারা চেঁচামেচি করে উঠছে, দেখে আমাদের ফূর্তি কী! বাড়ির ভিতরে সেদিন কি হত জানিনে, তবে আমাদের বয়েসে খেলেছি দোলের দিনে-আবীর নিয়ে এ- বাড়ি ও-বাড়ির অন্দরে ঢুকে বড়দের পায়ে দিতুম, ছোটদের মাথায় মাখাতুম। বড়দের রং মাখাবার হুকুম ছিল না, তাঁদের ওই পা পর্যন্ত পৌঁছত আমাদের হাত।”
অবনীন্দ্রনাথের এই বর্ণনার পর কেটে গিয়েছে অনেকগুলি বছর। আর এক দোলের ছবি পাওয়া গেল সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায়। “তখনো প্রতি বৎসর। ও বাড়ির বাগানে লতা-ঢাকা চায়ের ঘরে বসতো আমাদের ছেলেদের আড্ডা। আমাদের বন্ধুরা এসে জুটত, গাইতুম আমি হোলির গান আর আমার জ্যাঠতুতো ভাই নবেন্দ্র নাচত। বাড়ির মধ্যে মেয়েরাও দোল খেলতেন। একবার মনে আছে আমার মেজদিদিমা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, ১৯ নং স্টোর রোডের বাড়িতে দোল খেলার নেমন্তন্ন করেছিলেন সকলকে। সেবার তিন পুরুষের দোলখেলা হয়েছিল ১৯ নং স্টোর রোডের বিরাট বাগানে। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মেজদিদি জ্ঞানদানন্দিনী-এঁদের দল, তারপরে বাবা, কাকা, মা কাকীদের দল আর আমাদের ভাই বোনদের দল।”
এই স্টোর রোডের বাড়ি সম্বন্ধেই ইন্দিরা দেবী লিখেছিলেন,”….. সেটা একটা বাড়ির মতো বাড়ি ছিল বটে। বাইশ বিঘে জমি আর তিনটে পুকুর। তার মধ্যে পিছনের ফটকটা কড়েয়া রোডে গিয়ে পড়ত…..।” অমন রাজকীয় বাড়িতেই তিন পুরুষের দোল খেলা সম্ভব।
জোড়াসাঁকোর ৫ নং বাড়ির দোল খেলার ইতিহাস অনেক কালের। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সুমিতেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “ দাদামশায়ের মুখে শুনেছি আমাদের বাড়ির দোল উৎসব হত আমার প্রপিতামহ গুণেন্দ্রনাথের আমল থেকে। তখন প্রতি বছর বাড়ির ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে ফাগ খেলত- সন্ধ্যের পর বাড়ির দোতলার নাচঘরে বসত নাচ বা গানের জলসা। শুনেছি কর্তারা জাজিমের উপর তাকিয়া হেলান দিয়ে গড়গড়া বা ফরসি টানতে টানতে মশগুল হয়ে দেখতেন নাচ বা শুনতেন মার্গীয় সঙ্গীত।” ৫নং বাড়ির বিলিয়ার্ড ঘরের উত্তর দিক ঘেঁষে লতাপাতার নকশা দেওয়া সাদা কালো মার্বেলের মেঝের মধ্যে ছিল একটা ছোট্ট ফোয়ারা-“ দোলের দিন ঐ ফোয়ারার জলে কর্তাবাবাদের প্রাপ্তবয়স্ক নাতি-নাতনীরা দোল খেলতেন।”
এই বাড়ির খুব সুন্দর এক দোলের ছবি ধরা আছে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা পূর্ণিমা দেবীর লেখায়। “দোলের দিন আমাদের সকাল থেকে তোড়জোড় চলত। পিচকারি রং আসছে। আগের দিন ঠাকুরের পুজোর চাঁচর হত। খড়ের মানুষ করে বাগানে রেখে আগুন দেওয়া হত। আমরা বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতুম। তাঁর পরদিন বারোটা অবধি আবীর খেলা হত। বাগান, বাড়ি লাল হয়ে যেত। বোতল বোতল গোলাপজল ঢেলে রং গোলা হত। আমাদের খেলার পরে মেয়েদের, বাবা-কাকাদের খেলা শুরু হতে। খেলা শেষ করে খেতে তিনটে চারটে বেজে যেত। পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে অনেকেই আসতেন। বড়দাদার(গেহেন্দ্রনাথ)বিয়ের বছর খুব ধূম করে খেলা হয়েছিল। খেলার পর খাওয়াদাওয়া চলত। তারপর সন্ধের সময় বসে গানবাজনা হত। সকলে বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যেত।…… আমাদের সময় মেয়ে জামাইরা আনন্দ করছে দেখেই মা- বাবারা আনন্দ পেতেন। আমরা যা আবদার ধরেছি তাই দিয়েছেন। দোলের পরের দিন আবার দারোয়ানদের দোল দেখার নিমন্ত্রণ হত। সেদিনও যেতুম। গাড়িবারান্দার নীচে দারোয়ানরা বসে। তাদের যত বন্ধুবান্ধব আসছে, আবীর দিচ্ছে, এক লোটা সিদ্ধি দিয়ে খাতির করছে। সারাদিন গান করত আর ঝনাৎ ঝনাৎ বাজনা বাজাত। বাবা তাদের আনন্দ দেখতে ভালোবাসতেন। বাবার কাছ থেকে দশ টাকা নিত, তাই দিয়ে দুজন নাচওয়ালীকে আনত। রাত দশটা অবধি নাচ চলত। তারপরে আমরা খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি যেতুম।”
ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম যুগের শান্তিনিকেতনের এক ব্যতিক্রমী দোল খেলার কথা শুনিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। “একবার দোলের দিন রং খেলার শেষ হলেও আমাদের আশা মিটল না। আর কী করা যায় ভাবছি, এমন সময় নজরে পড়ল মাস্টারমশায় পরিষ্কার কাপড় পরে স্নান সেরে একটা খাটের উপর বারান্দায় শুয়ে বিশ্রাম করছেন। কথাবার্তা নেই, আমরা কয়েকজন বড়ো ছেলে খাটসুদ্ধ তুলে নিয়ে হরিবোল দিতে দিতে একেবারে বাঁধের জলে নিয়ে ফেললুম। তিনি উঠে বসে উত্তম-মধ্যম ধমক দিতে লাগলেন, আমরা সেটা তেমন খেয়াল করলুম না, তাঁর ঠোঁটের এককোণে একটুখানি হাসির রেখা দেখে মনে হল আমাদের এই ছেলেমানুষিতে তিনিও যেন মজা অনুভব করছেন। শেষে আমরা তাঁকে সেই অবস্থায় রেখে ফিরে যাচ্ছি দেখে ধমক দিয়ে উঠলেন, 'ওটি হবে না, যেমন করে এনেছিস ঠিক তেমনি করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, খাটে তোল বলছি’। আমরা আবার খাটখানা কাঁধে করে তাঁকে আশ্রমে যথাস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে এলুম।” এই অকারণের আনন্দই দোলের মূল সুর। পরবর্তীকালের শান্তিনিকেতনে এই ধরণের আমোদ দেখা যায় নি।
পুরোনো কলকাতার বাবুদের হোলির বর্ণনা দিয়েছেন ঈশ্বর গুপ্ত-“ ক্রমেতে হোলির খেলা/ নবীনা নাগরী মেলা/ ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই/ …যার ইচ্ছা হয় যারে, আবীর কুঙ্কুম মারে/ পিচকারি কেহ দেয় গায়।/ উড়ায় আবীর যত, কুড়ায় লোকেতে কত/ জুড়ায় দেখিলে মন তায়/ ঢালিলে গোলাপজল অঙ্গ করে সুশীতল/ মাঝে মাঝে হয় কোলাহল”। সেকালের কলকাতায় দোলের দিনের আনন্দে শরিক হত মুসলমান ও খ্রীস্টানরাও। জনসাধারণ প্রাণ খুলে ফূর্তি করত। সং বেরোত, অশ্লীল গান ও গাইত। নিয়ম বলে কিছু থাকত না।
লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ্ নির্বাসিত হয়ে এলেন মেটিয়াবুরুজে। সেখানে তিনি হোলি খেলতেন অনুচরদের নিয়ে। তাঁর লেখা একটি নাটক 'রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’-য় যমুনার তীরে পূর্ণচাঁদের রাতে কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে লীলারত। শোনা যায়,১৮৬৭ সালে হোলির সময় ওয়াজেদ আলি শাহ্ নাকি কথ্থক নৃত্য এবং ঠুমরি পরিবেশন করেছিলেন। সেকালের কলকাতায় টপ্পা, ঠুমরিতে দোল উদযাপনের রীতি ছিল। নিধুবাবুর টপ্পায় আছে- “আইল বসন্ত সকলে উন্মত্ত” আর রূপচাঁদ পক্ষী শোনান রাধাকৃষ্ণের বসন্তলীলা, “হোলি খেলিতে শ্রীহরি সহ রাধা প্রণালী/ কুঙ্কুম-ধূম শ্যাম অঙ্গ ভরি/……উড়ে আবীর গোলাল, বৃন্দাবন লালে/ লাল যমুনার বারি….”। দোলে লালে লাল হয়ে উঠত লাল দীঘির জল। তাই নাম হয়েছিল লালদীঘি। প্রাণকৃষ্ণ দত্তের লেখায় আছে, “ ইংরেজ আগমনের পূর্বে লালদীঘিতে দোলযাত্রার বড় ঘটা হইত।…. দীঘির জলে আবীর গুলে সেই জল পিচকারিতে নিয়ে রং খেলা হত”। দোলে এই অঞ্চলে বসত বিরাট মেলা।
দিন বদলে গিয়েছে। বদলে গিয়েছে দোল খেলার ধরণটি। দোলে ফুটকড়াই আর চিনির মঠ খাবার সহজ আনন্দ আজ আর নেই। নেই সেই ঐতিহ্য ভয় দোল উদযাপন। তবু দোল আসে। তবু আনন্দে মেতে ওঠে ধনী দরিদ্র সকলেই। রং-এর জোয়ার লাগে ধূসর শহরের ধূসরতর জীবনেও। মনে পড়ে যায় আজ দোল। এক চিলতে ঘরের একটুখানি জীবনে লাগে একটুকু ছোঁয়া।