বাস বাড়ির কাছে এলেই কন্ডাক্টর হাঁক দিত, ‘জনি ওয়াকার বাস স্টপ’

মালিশ...মালিশ...তেল মালিশ...

সানুনাসিক গলায় পার্কের ধারে এই অচিন ‘তেল মালিশওয়ালা’র এই ডাকে সাড়া দিয়েছিল এদেশের আট থেকে আশি। একটু পরেই শুরু হবে রফি সাহেবের গান তার আগে এই ডাক শোনতে কান পেতে থাকত গানের শ্রোতা আর দর্শকরা।

ছবির নাম পিয়াসা। ১৯৫৭তে মুক্তি। সাদা-কালো ছবির এই দৃশ্য কখনও পুরনো হবার নয়। দর্শকদের সবটুকু নজর কেড়ে নিয়েছিলেন অভিনেতা জনি ওয়াকার।

পেন্সিলের মতো সরু গোঁফ। মাথায় টুপি। হাতে ঝুলছে তেলের শিশিখানা। ঘুরে ঘুরে গান গাইছেন অভিনেতা। মুখের অভিব্যক্তি আর অভিনয়ের গুণে গান ছাপিয়ে তিনিই মুখ্য।

johny-1

এক মুহূর্তের জন্য থেমে থাকেন না অভিনেতা। ফ্রেম জুড়ে তাঁর চলাচল। ততবারও বদলে যায় এক্সপ্রেশন। মাত দর্শকরা। এক দৃশ্য দিয়েই জাত চিনিয়ে দেন অভিনেতা। বুঝিয়ে দেন কেন তিনি ভারতীয় সিনেমার অন্যতম ‘কাল্ট ফিগার’।

ছবির টাইটেল কার্ড আর দর্শকদের মুখে তিনি জনি ওয়াকার হলেও, আসল নাম কিন্তু আলাদা। বদরুদ্দিন জামালউদ্দিন কাজি। বলিউডের দুনিয়ায় পা রেখে নাম হয়ে যায় জনি ওয়াকার।

তবে শুনলে আশ্চর্য হবেন নাম ‘জনি ওয়াকার’ হলেও মদ থেকে হাজার শতহস্ত দূরে থাকতেন। তাঁর নাম দিয়েছিলেন গুরু দত্ত। বদরুদ্দিন ওরফে কাজিকে কে মাতালের ভূমিকায় অভিনয় করে দেখাতে বলেছিলেন তিনি। নবাগতের অভিনয় দেখে তাঁর নিজের প্রিয় স্কচ হুইস্কির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তিনিই বদরুদ্দিনের নতুন নামকরণ করলেন ‘জনি ওয়াকার’। সন্দেহ নেই সুরসিক ছিলেন গুরু দত্ত।   

বদরুদ্দিন কিন্তু শুরু থেকেই সিনেমার মানুষ নন। বোম্বাইয়ের বোম্বে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইয়ের ট্রান্সপোর্টে কনডাক্টর ছিলেন। কাজ করতেন দাদার বাস ডিপোতে। বাসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতে ফিরতে মজার মজার কথা বলতেন। তাঁর ক্যারিকেচার দেখে হেসে লুটোপুটি খেত প্যাসেঞ্জাররা। এভাবেই একদিন চোখে পড়ে গেলেন বলরাজ সাহানির।

বলরাজ তখন গুরু দত্তর জন্য ‘বাজি’ ছবির চিত্রনাট্য লিখছেন। বদরুদ্দিনকে চিনে নিয়েছিলেন তাঁর জুহুরি চোখে। দাদার ডিপোর বাস কন্ডাক্টরটিকে নিয়ে গেলেন গুরু দত্তর কাছে। সাবলীল অভিনয় আর আনন্দ দেওয়ার ক্ষমতা মুগ্ধ করেছিল গুরু দত্তকে।

johny-2

বদুরুদ্দিন হয়ে গেলেন সর্ব সাধারণের জনি ওয়াকার। অভিনয় দিয়ে নেশা ধরাতে পারতেন মানুষকে। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পর্দায় ফুটে ওটা কথা-কাহিনি আর জীবন দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষ ভুলে থাকতে চায় রোজকারের ক্ষোভ-রাগ-দুঃখগুলোকে। আনন্দ পেতে চায় সে। জনি ওয়াকার সেই কাজটাই করতেন। চূড়ান্ত সফল হয়েছিলেন।

বদরুদ্দিন জামালউদ্দিন কাজি খুব সামনে থেকে দেখেছিলেন জীবনের ওঠাপড়া। তাঁর জন্ম ইন্দোরে। বাবা ছিলেন মিলের শ্রমিক। দশ ভাইবোনের মধ্যে বদরুদ্দিন দ্বিতীয়। কোনরকমে নুন-ভাতে দিনগুজরান। কিন্তু আচমকা একদিন সেই সংস্থানটুকুও চলে গেল। বাবার মিল গেল বন্ধ হয়ে। সংসার অচল। বারোটা পেট। ছোট ছোট সন্তান।

গোটা পরিবার তখন অনিশ্চয়তার ঝোড়ো হাওয়ায় ভাসছে। শেষে উপায়ন্তর না দেখে তাঁরা চলে এলেন আরব সাগরের তীরের শহরটা।বিশেষ সুরাহা তাতে হল না। বাস্তবের পাথরে আছাড় খেতে খেতে প্রাণ হারালেন বদুরুদ্দিনের আব্বাজান। চাপ এসে পড়ল বদুরুদ্দিনের ওপর।

পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে নানারকম কাজ করতে লাগলেন। কখনও রুটিওয়ালার কাজ করেছেন। রাস্তায় বরফের আইসক্রিম বিক্রি, কখনও স্টেশনারি এমনি সবজিও বিক্রি করেছেন প্রয়োজনে। মাইলের পর মাইলে হেঁটে যেতেন। লড়াইয়ের ময়দান থেকে একচুল সরতে রাজি নন। জীবনের রাশটাকে সামলানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু মুখের হাসিটি এতটুকু ফিকে হয়নি।

জীবনের এই পর্বেই জীবনকে বড় কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। সমৃদ্ধ হয়েছেন অভিজ্ঞতায়। কীভাবে বেঁচে থাকে আপাত নিম্নবর্গের মানুষ। কোন ভঙ্গীতে কথা বলে তারা, কীভাবে হাসে, কীভাবে কাঁদে, কীভাবে ভুলতে চায় রুক্ষ বাস্তব- জনি সব জানতেন।  

১৯৫১-তে ছবির দুনিয়ায় তাঁর জার্নি শুরু হয়েছিল গুরু দত্তকে দিয়েই। একটি বাদে তাঁর প্রায় সব ছবিতে দেখা গিয়েছিল জনিকে। কমেডি করতেন কিন্তু তা ভীষণভাবে বুদ্ধিদীপ্ত। তাঁকে ভেবে গান রাখা হত ছবিতে। রফি তাঁর জন্য গান গেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি।

একদিন ভাতের লড়াই করতে হয়েছিল জীবনের সঙ্গে। সে লড়াই বৃথা যায়নি তাঁর। জীবন তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল দ্বিগুণ। প্রায় ৩০০’র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। পর্দায় উজাড় করে দিতেন নিজেকে। একটা সময় পর রবিবার আর শুটিং ফ্লোরে পাওয়া যেত না তাঁকে। ছবি নির্মাতা ও প্রযোজকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন রবিবার কাজ তিনি করবেন না। বলিউড অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম নিজস্ব সেক্রেটারি রেখেছিলেন।

থাকতেন বান্দ্রাতে। তাঁর বাড়িটা হয়ে উঠেছিল ল্যান্ডমার্ক। তাঁর মেয়ে তসনিম খানের কথায়, ‘বাসে করে কলেজ থেকে ফিরতাম। বাস বাড়ির কাছে এলেই কন্ডাক্টর হাঁক দিত, ‘জনি ওয়াকার বাস স্টপ …জনি ওয়াকার বাস স্টপ- ভীষণ লজ্জা করত আমার’।

বান্দ্রায় মুম্বইয়ের সেলিব্রিটি পাড়া। বহু জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর বাস। কিন্তু বাস থামত তাঁর নামেই। দিলীপ কুমার, নৌশাদ, মহম্মদ রফি আর জনি ওয়াকার ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সবাই থাকতেন বান্দ্রায়।  

১৯৫০-৬০ নিজস্ব ফ্যানবেস তৈরি করে ফেলেছিলেন। তবে গুরু দত্তের মৃত্যু তাঁর কাছে বড় ধাক্কা। তাঁর মৃত্যুর খবর যাখন পান তখন জনি শুটিং-এ ব্যস্ত। সব ফেলে ছুটে এসেছিলেন। গুরু তাঁর কাছে সত্যি সত্যিই ‘গুরু’! বদরুদ্দিন জামালাউদ্দিন কাজিকে তিনিই তো করেছিলেন ‘জনি ওয়াকার’।

তুখোড় বুদ্ধিমান ছিলেন। ষাটের দশকের পর থেকে ছবি করা কমাতে থাকেন। উপার্জনের কষ্ট তিনি জানতেন খুব ভাল করে, তাই প্রযোজনা বা ছবি সংক্রান্ত বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না। জীবনে একবার মাত্র ছবি প্রযোজনা করেছিলেন ১৯৮৫তে। ছবির নাম ‘পৌঁচে হুয়ে লোগ’। পরিবহন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। ১৯৮০ নাগাদ অবসর নেন অভিনয় থেকে। তখন থেকেই ধারা বদলাতে শুরু করেছিল হিন্দি ছবি, নতুন বদলের সঙ্গে মেলাতে চাননি নিজেকে। এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘’আমরা যখন অভিনয় করতাম, মাথায় রাখতাম হলে যিনি ছবি দেখতে আসছেন তিনি স্ত্রী-সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে আসছেন।

johny-4

অভিনয় জীবন থেকে পুরোপুরি সরে যাওয়ার পর, বহু বছর বাদে একবারই মাত্র ফিরেছিলেন তিনি পর্দায়। কমল হাসান ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁকে কমলের ‘চাচি ৪২০’ ছবির জন্য। অজস্র ছবির সেরা এই মানুষটি জীবনে দু’বার ফিল্মফেয়ার সম্মান পেয়েছিলেন। ১৯৫৮তে ‘মধুমতী’ ছবির জন্য সেরা সহঅভিনেতার সম্মনা, আর একবার ১৯৬৮-তে ‘শিকার’ ছবির জন্য সেরা কৌতুক অভিনেতার সম্মান।

 ছবির দুনিয়া তাঁকে সাফল্য দিয়েছে। অর্থ, খ্যাতি, নাম যশ- যা যা এক জীবনে মানুষের চাওয়ার থেকে সব পেয়েছেন। পরিশ্রম, মেধার জোরে। কিন্তু জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পরিবার। গ্ল্যামার দুনিয়ার প্রথমসারির মানুষ হয়েও কখনও ভোলেননি নিজের অতীত। ভুলতে পারেননি যে তিনি ছিলেন এক মিল শ্রমিকের সন্তান। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কীভাবে দু মুঠো অন্ন জোগাড়ের দায়ে এসে উঠেছিলেন মায়ানগরীর ঘিঞ্জি বস্তিতে। তাই মাটির কাছাকাছি থেকেছেন আজীবন। সন্তানদের দিয়েছেন মরমী হয়ে ওঠার শিক্ষা। বাবার কথা বলতে গিয়ে তাঁর মেয়ে বলেন, কীভাবে জনি ছেলেমেয়েদের পাড়ার বৃদ্ধ শিঙাড়া ওয়ালার কাছে থেকেই শিঙাড়া কিনতে পাঠাতেন। টাকার অভাবে ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল, সারাজীবন থেকে গিয়েছিল সেই আফসোস। সন্তানকে তাই তপড়তে পাঠিয়েছিলেন বিদেশে। নিজের পড়ার ইচ্ছেটা পূরণ করেছিলেন এভাবেই।

 

   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...