কলকাতার এই হোটেলকে ইউরোপের মানুষ ডাকত ‘জুয়েল অব ইস্ট’ ।
এই হোটেলের রেস্তোরাঁর টেবিলে বসেই 'বিফ' আর 'সুরা'র স্বাদে হিন্দু গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। শহর কলকাতার নানা রং বদলের সাক্ষী এই হোটেল।
উইলসন সাহেবের হোটেল। আসল নাম অকল্যান্ড হোটেল। আর এখন যার নাম গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল। ওরফে দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিনি পয়সার ভোজ’ নাটকের এক জায়গায় লিখেছেন, “পরের তহবিল, চোকায় উইলসনের বিল...”
এই উইলসন আর অকল্যান্ড হোটেলের মালিক উইলসন সাহেব একজনই।
কলকাতায় তখন ব্রিটিশদের রমরমা। নিজেদের মত করে তারা সাজিয়ে তুলছে শহর। সুতানুটি গোবিন্দ পুর গ্রামের গা থেকে ‘ গেঁয়ো’ ছাপ তুলতে ঘষা মাজাও চলছে জোরকদমে। নানা কাজে সাহেবরা আসতে শুরু করেছে কলকাতায়। ব্যবসা বানিজ্য বাড়ছে। শুধু সাহেবরাই নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজা, জমিদাররাও আসছেন রাজধানী কলকাতায়। ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে দেখা করতে।
কিন্তু থাকবেন কোথায়? রাত কাটাবেন কীভাবে?
তাঁদের অনেকেরই কলকাতায় কোনও বাড়ি বা থাকার জায়গা ছিল না। হোটেল কোথায় কলকাতায়?
হোটেল বলতে তখন শুধুমাত্র লাটভবন। লাটভবন এখন রাজভবন।
আর সময় কাটাবার জায়গা বলতে স্পেনসাস। কিন্তু চা বাগান আর মাইন এলাকার সাহেবরাই মূলত সেখানে যেত। ইউরোপের বিলাসবহুল হোটেলের তুলনায় স্পেনসাস কিছুটা ম্লান।
কসাইতলার উইলসন সাহেব ব্যবসাদার মানুষ। কলকাতায় ‘এলিট ক্লাস’র থাকার জায়গার অভাব খেয়াল করলেন।
কলকাতার বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের চীনে পাড়ার নাম ছিল কসাইতলা। এখানেই ডেভিড উইলসন সাহেবের বেকারি ছিল। সেখানে কেক, পাউরুটি, বিস্কুট বিক্রি হত। তিনি ভাবলেন এখানে যদি ‘হোটেল’ করা যায় তাহলে মুনাফা মার খাবে না।
ভাবনাকে কাজে লাগাতে তিনি দেরি করলেন না। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিট আর ওল্ড কোর্ট স্ট্রিটের মাঝখানের লম্বা রাস্তাটায় উইলসন সাহেব তাঁর হোটেল চালু করলেন। ১৮৪১-র ১৯ নভেম্বর। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল অব ইন্ডিয়ার উপাধি থেকে সাহেব তাঁর হোটেলের নাম দিলেন ‘অকল্যান্ড হোটেল’। লোকের মুখে ফিরত ‘উইলসন সাহেবের হোটেল।
১৮৫০ সাল অবধি ‘D. Wilson & co’ নামেই হোটেলটি ছিল। পরে তাকে আরও বড় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের বছরই ওল্ড কোর্ট স্ট্রিটে চলে আসে অকল্যান্ড হোটেল। আজকে যেখানে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল রয়েছে সেই ঠিকানায়। এখন হেমন্ত বসু সরণি।
১৮৬৯ নাগাদ কলকাতায় বিদেশি পর্যটক আরও বেড়ে যায়। সুয়েজ খাল তৈরি তার একটা কারণ। ইউরোপ থেকে মধ্য প্রাচ্য পর্যন্ত জাহাজ চলত। মাঝে বম্বে টু কলম্বো। জাহাজটির নাম ছিল ‘গ্রেট ইস্টার্ন’। ক্ষুরধার ব্যবসায়ী উইলসন সাহেব হোটেলের নতুন নাম দিলেন ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’। লক্ষ্য হোটেলে আরও বেশি পর্যটক ও অতিথি টানা।
সে সময় রাজা –মাহারাজা দের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। গ্রেট ইস্টার্ন তখন স্ট্যাটাস সিম্বল।
বেশ কয়েকবার মালিকানা বদল হয় গ্রেট ইস্টার্নের। হোটেল গড়ে উঠেছিল ৫ জন অংশীদার নিয়ে। ১৮৬৫ তে এক বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়। প্যারিচাঁদ মিত্র(বিখ্যাত সাহিত্যিক) উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম প্রেসিডেন্ট গ্রেট ইস্টার্নের অংশীদার ছিলেন।
গ্রেট ইস্টার্ন ভারতের প্রথম হোটেল যেখানে বিদ্যুতের আলো এসেছিল। ‘গাড়ীবারান্দা’ ব্যাপারটা কলকাতা জেনেছিল এই হোটেল থেকেই।
গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে ‘ম্যাক্সিম’ নামে একটা রেস্তোরাঁ ছিল। প্যারিসের ‘ম্যাক্সিম’ রেস্তোরাঁর আদলে। সেখানেই মধুসূদন গো মাংস খেয়েছিলেন। এই রেস্তোরাঁতে দেশি বিদেশি অভিজাতদের নিয়মিত পার্টি চলত। ‘পার্টি গসিপ’ মুখরোচক গল্প পরের দিন সকালে কাগজের পাতায় বের হত।
হোটেলের ১০০ টি রুম। হোটেলের ২০৮, ২০৯, ২১০, ২১১ নং স্যুইটগুল ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল। ভাড়াও আকাশছোঁয়া। অভিজাত ধনকুবেররা ব্যবহার করতেন।
এই সমস্ত স্যুইট যারা নিত তাঁদের নিজস্ব প্রচারক থাকত। তাদের বেল্টে মনিবের নাম খোদাই করা- সঙ্গে ‘হিজ হাইনেজ’।
হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল ভিন্ন রকম। সারা কলকাতায় দেশি পুলিশের প্রহরা চললেও গ্রেট ইস্টার্ন সামলাত ব্রিটিশ পুলিশ। হোটেলের সামনে যাতে গোরুর গাড়ি এসে না পড়ে একজন পুলিশের কাজ ছিল শুধু সেটা সামলানো।
১৯৩০এ এই হোটেলের দায়িত্ব পুরোপুরি ভারতীয় হাতে চলে যায়।
দেশ স্বাধীন হবার পরও গ্রেট ইস্টার্নের আলাদা মর্যাদা, জৌলস ছিল। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, অতিথিরা এলে এখানেই থাকতেন। ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হো চি মিন যখন ভারতে আসেন এখানেই থেকেছিলেন।
কলকাতা শহরের ‘বাবু কালচার’এ আলাদা ধারার জন্ম দিয়েছিল গ্রেট ইস্টার্ন। কসমোপলিটন কলকাতা অন্য ভাবে ধরা দিয়েছিল। ভারতীয়, বাঙালি, ব্রিটিশ, ইউরোপিয়, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সব ধরনের কমিউনিটি কালচার চলত। এমনকি এখানকার মাছ-ভাতের টানে জাপান কোরিয়ার মানুষ এত বেশি আসত যে এই হোটেলের এক সময় নাম হয়ে গিয়েছিল ‘জাপানি হোটেল’।
সত্তর দশকের শুরু থেকে এই হোটেলের অবস্থার অবনতি হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৭৫ –এ গ্রেট ইস্টার্ন অধিগ্রহণ করে।
২০০৫ সালে ঐতিহ্যবাহী হোটেলটি নিলাম হয়। এই হোটেল এর মালিক হয় ভারত হোটেল। ৩৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। তারপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আবার নতুন করে খুলে দেওয়া হয় ‘গ্রেট ইস্টার্নে’র দরজা। এবার তার নতুন নাম ‘দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন’।