#EXCLUSIVE: স্মৃতিঘেরা নির্বাসনের দ্বীপ

               ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধের পর ব্রাজিলের রিও -দি-জেনিরো থেকে ৪০০০ কিলোমিটার পূর্বে একটি দ্বীপ ইতিহাসে বহুচর্চিত ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে, কারণ ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ান পরাজিত হলে তাকে এই দ্বীপেই নির্বাসিত করা হয়। যা সেন্ট হেলেনা নামে পরিচিত। ফরাসি অধীনস্ত লংউড হাউসে নেপোলিয়ানের থাকার ব্যবস্থা করা হয়, যদিও ৬ বছর থাকার পর ৫১ বছর বয়েসে তিনি মারা যান। কিন্তু এই দ্বীপের ৫০০বছরের পুরনো ইতিহাস আছে। ১৫০২ সালে পর্তুগিজদের প্রথম নজরে আসে সেন্ট হেলেনা দ্বীপটি। তখন এখানে মানব বসতি ছিল না - প্রাচীন দ্বীপের মধ্যে এই সেন্ট হেলেনা ছিল অন্যতম। ১৫০২ সালের ২১ শে মে ভারতবর্ষ থেকে দেশে ফেরার সময় পর্তুগিজ নাবিক জোয়া - ডা -নোভা এই দ্বীপ আবিষ্কার করেন।

তিনি বিখ্যাত সম্রাট কনস্টান্টাইন দা গ্রেট এর মা 'হেলেনে'র নামে দ্বীপটি দেন। কাকতালীয়ভাবে ওই দিন ছিল হেলেনের জন্মদিনজোয়ার জাহাজ ছিল সেন্ট হেলেনার প্রথম জাহাজ, দ্বীপের নির্জনতায় ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার সদস্য ফর্নান্দো লোপেজ পর্তুগাল ত্যাগ করে ওই দ্বীপেই বসবাস শুরু করেন। এককথায় বলা যায় যে তিনি দ্বীপের প্রথম বাসিন্দা। এর পর ওই দ্বীপের কথা চাউর হলে পর্তুগিজ জাহাজ দীর্ঘ নৌ-অভিযানের বিরতির জন্য এই দ্বীপটি ব্যবহার করতো। প্রাথমিক ভাবে ডাচ শাসনভুক্ত হলেও দ্বীপটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়, পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একচেটিয়া শাসনভুক্ত হয়। এটি ব্রিটিশদের দ্বিতীয় উপনিবেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই দ্বীপকেই তারা নির্বাসনের জন্য ব্যবহার করে। আফ্রিকার দিলজুলু ব্রিটিশদের বিরোধিতা করলে ইংরেজরা বন্দি করে তাকেও এইখানে পাঠায়। উপকূল অঞ্চল থেকে অনেকটা দূরে হওয়ায় নির্বাসনের জন্য এই দ্বীপ যথার্থ। ১৮৩৪ সালে কোম্পানির শাসন শেষ হয় এবং এই দ্বীপ ক্রাউন কলোনি হিসেবে পরিচিত হয়।  

       

               আয়তনে দ্বীপটি ১২১ বর্গকিলোমিটার। এখানে বসবাসকারী মানুষগুলোর পূর্বপুরুষ অধিকাংশই কোনো না কোনো অঞ্চল থেকে নির্বাসিত, বিতাড়িত বা দাস সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই এই স্থানে মিশ্র সংস্কৃতি লক্ষিত হয়। ৮টি জেলায় বিভক্ত এর রাজধানী জেমসটাউন। এইসময়ে অন্যতম ঘটনা হ্যালির উত্থান। তিনি এখানে বেশ কিছুকাল বসবাস করেন ও মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করে তারকা পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়াও ম্যানুয়েল জনসন বিখ্যাত জ্যোর্তিবিদ এখানেই ছিলেন যদিও তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে নেপোলিয়ানের রক্ষীবাহিনীর অন্যতম তারুণ্য ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর সৈনিক ছিলেন।

             যাইহোক সুয়েজখাল ও বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগে এই দ্বীপটি বাণিজ্যের বিশেষ সহায়ক ছিল১৭৫০ সালের পর এখানে একাধিক ব্রিটিশ পরিবার নিজেদের দাস নিয়ে আসতো, যাদের কাজ ছিল দ্বীপের জঙ্গল পরিষ্কার করা। এছাড়া আফ্রিকা থেকে দাস মুক্ত হয়ে কাজের জন্য আসতো। একসময় বিশেষ করে অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকে। এখানে দাসের সংখ্যা প্রায় ৩গুন বেড়ে যায়। ফলে ১৭৯২ তে রাজকীয় ডিক্রী জারি করে দাস নিয়ে দ্বীপে আসা নিষিদ্ধ হয়। ১৮৪১ এ হাজার খানেক দাস আফ্রিকা থেকে পালিয়ে এলে সমস্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকে। ১৮৬৯সুয়েজ খাল শুরু হলে এই অর্থনীতি একেবারে ভেঙে যায়। যদিও আবার তা ঘুরে দাঁড়ায় কারণ কোনো সমস্যাই চিরন্তন নয়। এই দ্বীপে একধরণের ফার্ন জন্মায়, যা থেকে শন চাষ হতো। এই চাষ ক্রমে মূল অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। যদিও একসময় সেই চাষ বন্ধ হয়। এখানে পণ্য পরিবহনের মাধ্যম ছিল নৌপথ। 'রয়েল মেইল শিপ' এই দ্বীপের জীবনীশক্তি। দৈনন্দিন চাহিদাও মেটে এই জাহাজের মাধ্যমে। রয়েল মেইল শিপ এর মধ্যে অন্যতম পর্যটক ও মাল পরিবহনের এই ১টি জাহাজ। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে ৫দিনের ব্যবধানে এই জাহাজ ৩০০০ কিলোমিটার দূরবর্তী স্থান এই সেন্ট হেলেনা দ্বীপে আসে।

          ৭ মিলিয়ন বছর আগে আগ্নেয়গিরি অগ্নুৎপাতলব্ধ এই দ্বীপটি বর্তমানে অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ, যা ব্রিটিশ ওভারসিস টেরিটোরির অন্তর্ভুক্ত। প্রতি বছর ৫০০০০ এর বেশি পর্যটক এখানে ভ্রমণ করে তাই ২০১৫ সালে ২৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করে এয়ারপোর্ট নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও এখানে ২টি চ্যানেল, ১টি রেডিও স্টেশন,নিজস্ব বোয়িং বিমান, ব্যাঙ্ক, পুলিশ বাহিনী আছে। তবে বর্তমানে মৎস শিল্প, পর্যটন, ডলফিন শো সহ একাধিক অর্থউপার্জনের ব্যবস্থা আছে। নেপোলিয়ানের স্মৃতি বিজড়িত এই দ্বীপের শহর ক্রমে আরো পরিণত হচ্ছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...