ষড় গোস্বামীর অন্যতম বৈষ্ণব সাধক ছিলেন রঘুনাথ দাস গোস্বামী। জমিদার পুত্র থেকে ভোগবিলাস ত্যাগ করে কীভাবে তিনি বৈষ্ণব সাধক হয়ে উঠলেন সেই ঘটনা অনেকেই জানেন না। আজকের প্রতিবেদনে সেই ঘটনা-ই বলব।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে নবাব হোসেন শাহের আমলে হুগলি জেলার সরস্বতী নদীর তীরে সপ্তগ্রামের প্রান্তেই ছিল শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রাম। এই গ্রামে শ্রীহিরণ্য ও গোবর্ধন দাস ছিলেন অত্যন্ত প্রতিপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি, তাঁরা জাতিতে ছিলেন কায়স্থ, রাজ প্রদত্ত উপাধি ছিল মজুমদার। এই গোবর্ধন মজুমদারের পুত্র বৈষ্ণব ভক্ত শ্রী রঘুনাথ দাস।
১৫০১ খ্রিস্টাব্দে গোবর্ধনের ঘর আলো করে তাঁর জন্ম হয়। মোট ১৯ বছর তিনি গৃহে ছিলেন। নীলাচলে ছিলেন ১৬ বছর আর ৫৬ বছর ছিলেন বৃন্দাবনে। এই বৈষ্ণব তপস্বী মোট ৯১ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৫৯২ সালে তিনি ইহলৌকিক লীলা ত্যাগ করে বৈকুন্ঠে যাত্রা করেন। ছোট থেকেই রঘুনাথের মধ্যে বিষয় সম্পত্তির প্রতি প্রবল অনাসক্তি দেখা গিয়েছিল। রঘুনাথ ছিলেন অত্যন্ত ভক্তিমান, বিনয়ী ও প্রতিভাসম্পন্ন। ধর্মবোধ আধ্যাত্মিক চেতনা প্রথম থেকেই তার মধ্যে ছিল। তারপর হরিদাস বাবাজীর সংকীর্তন শুনে তার বালক মন ভক্তিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে।
বাড়ির কাছে চাঁদপুর গ্রামে বলরাম আচার্যের বাড়িতে রঘুনাথের পড়াশোনা শুরু হয়। ছোট থেকেই রঘুনাথের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রবল হলেও পড়ার বইয়ের প্রতি তার কোনও আকর্ষণ ছিল না। এরপর রঘুনাথ মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যর নাম শুনলেন ও সেই মুহূর্তে মনে মনে মহাপ্রভুর চরণে নিজেকে বিকিয়ে দিলেন, ঘরে মন টেকা দায় হয়ে উঠল তার।
গৃহত্যাগের বাসনা নিয়ে সুযোগ খুঁজতে শুরু করলেন তিনি। এমন অনেকবার ঘটেছে যে, রঘুনাথ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন আর বাড়ি থেকে লোকজন খুঁজে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। গোবর্ধন দাস যখন বুঝতে পারলেন তার ছেলে মনে মনে গৃহত্যাগের কঠোর সংকল্প করে ফেলেছেন , তখন ছেলেকে কঠোর পাহারায় রাখলেন তিনি। রঘুনাথের উপর নজর রাখার জন্য পাঁচজন পাহারাদার নিযুক্ত করা হল, রঘুনাথকে সান্ত্বনা দেওয়া ও সেবা করার জন্য নিযুক্ত হল আরও কিছু দাসদাসী।
রঘুনাথ একদিন জানতে পারলেন শান্তিপুরে শ্রী অদ্বৈত প্রভুর ঘরে মহাপ্রভু অবস্থান করছেন। তখন রঘুনাথ তার বাবাকে আবদার করেন, "বাবা,আমাকে অন্ততঃ একবার শান্তিপুরে যেতে দাও। আমি মহাপ্রভুকে দর্শন করব।"-অনেক অনুরোধের পর গোবর্ধন দাস ছেলেকে শান্তিপুরে যাওয়ার অনুমতি দেন। এরপর মহাপ্রভুকে দর্শন করে রঘুনাথ কেঁদে কেঁদে বলে," প্রভু আমাকে তোমার চরণ আশ্রয় দাও।" মহাপ্রভু রঘুনাথকে আশ্বাস দেন ও বলেন, "যাদের অন্তরে বৈরাগ্য জেগেছে, তারা বহিঃসাধক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অন্তরের বৈরাগ্য বাইরে প্রকাশ না করে নির্লিপ্তভাবে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করলেই প্রকৃত ফল পাওয়া যায়। যারা পরকে দেখাবার জন্য বৈরাগ্য অবলম্বন করে তাদের কখনও ইষ্ট লাভ হয় না। তুমি আগের মতো সংসারের কর্তব্য পালন করে যাও। ঈশ্বর অবশ্যই তোমাকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দেবেন। আমি তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছি। আমি যখন বৃন্দাবন পরিক্রমা করে নীলাচলে অবস্থান করব, সেই সময়ে তুমি আমার আশ্রয় পাবে।"
এই কথা শুনে রঘুনাথ বাড়ি ফিরে এলেন। এরপর নিত্যানন্দ প্রভু পানিহাটি আসেন হরিনাম প্রচারের জন্য তখন রঘুনাথ ঠিক করলেন তিনি নিতাই কৃপা প্রার্থনা করবেন ও নিজের বন্ধন দশা ঘুচিয়েই ছাড়বেন। এইসময় তার জেঠু ও বাবা তাকে অনুমতি দিলেন, অনুমতি দেওয়ার পিছনে কারণও ছিল। আসলে এই সময় রঘুনাথ বিষয় সম্পত্তির কাজকর্ম ভালো দেখাশোনা করছিলেন, সপ্তগ্রাম থেকে পানিহাটি বেশি দূরও নয়, তাছাড়া রঘুনাথের সাথে পাহারাওলাও যাবে সেই কারণে তারা আপত্তি করেননি। লোকজনকে সাথে নিয়ে রঘুনাথ তখন নিত্যানন্দ দর্শনে যান।
নিত্যানন্দের কাছে যেতেই রঘুনাথের মাথায় পা তুলে দেন নিত্যানন্দ প্রভু এবং বলেন ,' ওরে চোরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলিস, এবার ধরে ফেলেছি তোকে দন্ড দেব।' আসলে রঘুনাথ নিজের ভক্তের রূপটি গোপনে রেখে বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করছেন সেই কারণে তাকে চোরা বলা হয়েছে আর তাকে দন্ড হিসেবে নিত্যানন্দ প্রভু বলেছেন, তার সমস্ত ভক্ত পরিজনদের দই চিঁড়ে ফলার খাওয়াতে হবে। বলাই বাহুল্য রঘুনাথ এই দণ্ড বিধান মাথায় পেতে নেন এবং তিনি লোকজনদের পাঠিয়ে সেই সময় দই চিঁড়ে সন্দেশ জোগাড় করে আনেন এবং হাজার হাজার ভক্ত মানুষকে ফলার খাইয়ে পরিতৃপ্ত করেন এই উৎসব পানিহাটির চিড়া দধি উৎসব নামে খ্যাত। আজও মহাসমারোহে পানিহাটিতে এই উৎসব হয়।
নিত্যানন্দ মহাপ্রভু রঘুনাথকে আশ্বাস দেন খুব শীঘ্রই তিনি চৈতন্যের কৃপা পাবেন। এরপর যথাসময়ে চৈতন্য মহাপ্রভু বুকে টেনে নিলেন রঘুনাথকে। সদ্য পরিণীতা সুন্দরী স্ত্রী , পিতার বিপুল বিষয় সম্পত্তি - সমস্ত আকর্ষণ ত্যাগ করে মহাপ্রভুর শরণ নিলেন রঘুনাথ। জমিদার পুত্র থেকে তিনি হয়ে উঠলেন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। মহাপ্রভু তার শিষ্য স্বরূপ দামোদরের ওপর তার যাবতীয় ভার অর্পন করলেন। এরপর শুরু হল রঘুনাথের কঠোর সাধনা। রঘুনাথের কঠোর কৃচ্ছ সাধনে খুশি হয়ে মহাপ্রভু তাকে দুটি জিনিস দান করেন একটি গোবর্ধনশিলা আর একটি গুঞ্জা মালা। এই মালাটি বুকে নিয়ে মহাপ্রভু শিলাখণ্ডটির পুজো করতেন আর শ্রীকৃষ্ণের গোবর্ধন লীলা স্মরণ করে ভাবাকুল হতেন। স্বরূপ দামোদর বলে দিলেন যে এই দুটি দানের অর্থ কী ? এই দুটি দানের অর্থ হল সাধনায় সিদ্ধি লাভের জন্য তাকে বৃন্দাবনে যেতে হবে এবং রাধারানীর চরণ তাকে আশ্রয় করতে হবে।
দীর্ঘ ষোল বছর কেটে যায় তারপর হঠাৎ করে মহাপ্রভু দেহত্যাগ করেন এবং মহাপ্রভুর বিরহ সহ্য করতে না পেরে স্বরূপ দামোদরও দেহত্যাগ করেন। তখন শোকগ্রস্থ রঘুনাথ চলে যান বৃন্দাবনে। সনাতন ও রূপ গোস্বামী তাকে পরম স্নেহে বুকে টেনে নেন। বৃন্দাবনে শুরু হয় রঘুনাথ গোস্বামীর কঠিন সাধনা। শ্যাম কুণ্ড ও রাধা কুণ্ড কলিকালে বিলুপ্ত হয়েছিল শ্রী গৌরাঙ্গ তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন কিন্তু ওই কুন্ড দুটিতে অল্প মাত্র জল ছিল , রঘুনাথের ইচ্ছা হল সেই দুটি কুন্ডকে তিনি পুনরায় জল পূর্ণ করবেন ও কুন্ড দুটির আগের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু মনে মনে এমনটা ভাবলেও কিভাবে তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে এই চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, নিজের বলতে তার কিছুই নেই আর কুন্ডদুটির সংস্কার করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন! এত অর্থ কোথা থেকে আসবে?- এই নিয়েই তার ভাবনা।
এদিকে একজন শেঠ জি স্বপ্নে আদেশ পেয়ে রঘুনাথ গোস্বামীর কাছে হাজির হলেন ও রঘুনাথ দাস কে বলেন আপনি অনুমতি দিন যত অর্থ লাগে আমি দেব ওই কুন্ড দুটি আমি সংস্কার করতে চাই। রঘুনাথ আপত্তি করেন না, কুন্ডদুটির পঙ্কোদ্ধারের জন্য অনেক লোক নিযুক্ত হলো এরপর শুরু হলো কুন্ড সংস্কারের কাজ , সুনির্মল জলে কুন্ড পূর্ণ হয়ে উঠলো। রাধাকুণ্ডে থাকাকালীন রঘুনাথ দাসের সঙ্গী ছিলেন চৈতন্যচরিতামৃতের লেখক শ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ। উল্লেখ্য এই রাধাকুণ্ডের তীরে একদিন যোগে থাকা অবস্থায় রঘুনাথের আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়।তার উপদেশামৃত যা আজও বৈষ্ণব সমাজে অতিশয় আদৃত।