বাংলা নাট্য জগৎ এর এক মহান নাট্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন শম্ভূ মিত্র। ১৯১৭ সালের ১২ই আগস্ট কলকাতার ভবানীপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শরৎকুমার বসু ও মাতা শতদলবাসিনী দেবী। তিনি প্রথমে বালিগঞ্জ কলেজে পড়াশুনো সমাপ্ত করে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কলেজের পড়াশুনো সমাপ্ত করতে পারেননি। অভিনেতা হিসাবে তাঁর মঞ্চে আত্মপ্রকাশ মাত্র কুড়ি বছর বয়সে। ১৯৩৫ সাল থেকে শুরু করেও আমৃত্যু তিনি থিয়েটারকে আটকে ধরে ছিলেন। কেবল মাত্র অভিনেতা হিসাবেই তিনি মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হননি তিনি একাধারে ছিলেন নাট্যকার, নাট্যপরিচালক এবং নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধকার। ১৯৩৯ সালে রংমহলের বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে যোগ দেন। এর পরে তিনি গিয়েছিলেন মিনার্ভাতে। এই সময়টাতেই তাঁর খ্যাতনামা নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি শিশির ভাদুড়ীরর প্রযোজনায় আলমগীর নাটকে অভিনয় করেন। যদিও তখন থেকেই তিনি ঠিক করেছিলেন অন্য ধরণের নাটক তৈরী করবেন।
১৯৪৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর গণনাট্য সংঘে কাজ করার সময়ে তার বিবাহ হয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালের ১লা মে 'বহুরূপী' নাট্যদলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রূপ থিয়েটার বলতে আজ আমরা যা বুঝি সেই গ্রূপ থিয়েটারের প্রকৃত সূচনা হয়েছিল এই বহুরূপী গ্রূপের মাধ্যমে। কিন্তু শম্ভূ মিত্র কোনো দিন ও বহুরূপী নাট্যদলের সভাপতি বা সম্পাদকও হননি। কিন্তু তিনি ছিলেন এই দলের কর্ণধার। ১৯৪৯ সালে তুলসী লাহিড়ীর পথিক প্রযোজনার মধ্য দিয়ে বহুরূপী নাট্যদলের সূচনা হয়। ১৯৪৯ এর পথিক থেকে শুরু করে ১৯৭২ তে 'চোপ', 'আদালত চলছে’ একের পর এক নাটক মঞ্চ সফল নাটক। তুলসী লাহিড়ী সেই সময়ের বিখ্যাত নাট্যকার। তাই তাঁর লেখা 'পথিক', 'ছেঁড়া তার' এছাড়াও বহু নাটক প্রযোজনা করেছেন বহুরূপী। শম্ভূ মিত্রের নিজের লেখা 'উলুখাগড়া' (১৯৪৯),'বিভাব' (১৯৫১)। তিনি নাটকের ফর্ম ও প্রেজেন্টেশন নিয়ে যে রকমের এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছিলেন তা তিনি বিভাব নাটকে করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপর তিনি হাত দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'চার অধ্যায়' নাটকে (১৯৫১)। স্বাধীনতার চার বছর পর রবীন্দ্রনাথের এই উপন্যাস কে নাট্যরূপ দেওয়া হয়। নাটকটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা স্মরণ করে বলেছেন সব আলো নিভে গেলে নেপথ্যে ভেসে ওঠে গম্ভীর গলায় চন্ডীর স্তোত্র। এই স্তোত্র শেষ হতে না হতেই শোনা যায় বহু কণ্ঠের সুর বন্দে মাতরম। বহুরূপী প্রযোজিত শম্ভূ মিত্র পরিচালিত নাটকগুলি হল 'রক্তকরবী', 'পুতুল খেলা', 'মুক্তধারা', 'কাঞ্চনরঙ্গ', 'বিসর্জন', 'রাজা', 'বাকি ইতিহাস', 'পাগলা ঘোড়া' প্রভৃতি। তাঁর নির্দেশক জীবনের শেষ চার বছর খুব উল্লেখযোগ্য। সেই জন্যই নাট্যকার বাদল সরকার দৰ্শকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছিলেন। বাকি ইতিহাস, রিয়ালিজম, থেকে খানিক সরে কিছুটা অ্যাবসার্ড এই নাটক গুলির দ্বারা বাংলা থিয়েটারে বহুরূপী নতুন বাঁক নেয়। এর সাথেই তিনি নিয়ে এলেন গিরিশ কারনাড কে। জীবনের শেষ সীমানায় এসে তিনি লিখেছিলেন যে কোনো নাট্যরূপই আমরা অবলম্বন করি না কেন আমাদের উদ্দেশ্য হল দিনের সমস্যা কে দর্শকের সামনে তুলে ধরা। আজকের দিনের কষ্ট কে আজকের দিনের চেষ্টাতেই প্রতিফলন করা। বাংলা থিয়েটার কে সমৃদ্ধ করেছে শম্ভূ মিত্রের কর্ম।