পিগমি সর্দার গুরানকে মনে আছে? খুলি গুহায় তার যাতায়াত ছিল অবাধ। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'আবার যখের ধন'-এর সেই দুর্দান্ত যোদ্ধাও ছিল পিগমি। সবটাই সাহিত্য। কোথাও কল্পবিজ্ঞান। কিন্তু বাস্তব! বাস্তবে এমন মানুষের কথা কতটা মনে রাখি আমরা? আসলে এই বাস্তব সভ্যতার এক অন্যরকম অধ্যায়। তাই আমাদের মনে নানা সন্দেহ, আগ্রহ তৈরি করলেও এসব খবরে স্থায়িত্ব কম। মাটির আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাথরের মত সেইসব ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। কিন্তু সেই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা মানুষটার জীবন ছিল করুন।
ওটা বেঙ্গা। কারোর মতে এই পিগমি মানুষটি সভ্যতার বুকে বৈষম্যের প্রতীক। আবার কেউ বলেন, মানুষ আর তার পূর্বপুরুষের মধ্যে মিসিং লিঙ্ক এই ওটা বেঙ্গা। এককথায় জীবন্ত জীবাশ্ম। এই পিগমি মানুষটির এই পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছনোর বৃত্তান্ত ছিল বড় করুণ।
সময়টা ১৯০৬ সাল। নিউইয়র্কের ব্রঙ্কোস চিড়িয়াখানা। ভিড় জমিয়েছে অনেক মানুষ। সেই ভিড় কোন পশুকে দেখতে ছুটির দিনের বিশেষ ভিড় নয়। ভিড় ছিল একজন 'মানুষ' দেখার জন্য। যাকে মজা করে অনেকেই 'আইটেম' বলছিলেন। দেখতে ছোটখাটো একজন পুরুষ। গায়ের রং মিশমিশে কালো। অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দাঁত ছুরির ফলার মতো। নাম ওটা বেঙ্গা। আফ্রিকার জঙ্গল থেকে খুঁজে পাওয়া এই মানুষ নাকি মানবজাতির সবচেয়ে পুরনো বংশধরের উত্তরপুরুষ। তাই জীবন্ত জীবাশ্ম দেখতে ভিড় জমাতো মানুষ।
১৮৮৩ সালে মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোর জঙ্গল। ওটা বেকার জীবনের গল্প অনেকটাই জঙ্গল-মানব টারজান এবং অরণ্য-শিশু মোগলির মত।
কঙ্গোর জঙ্গলে সেই সময় রাজত্ব করত রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড। তাঁর রাজত্বকালে কঙ্গো পরিণত হয়েছিল বেলজিয়ামের উপনিবেশে। এখানেই জন্ম হয় ওটা বেঙ্গার। বিয়ে হয়েছিল কম বয়সেই। পিগমি প্রজাতির এই মানুষটি থাকতেন জঙ্গলে। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে সুখী পরিবার ছিল তাঁর। একবার শিকার করতে বেরিয়েছিলেন এই অরণ্য মানব। ফিরে এসে দেখেন শুভ মানুষের আক্রমণে গ্রাম উজাড়। রাজার সেনাদের অতর্কিত আক্রমণে সকলেই মারা গিয়েছেন। বাদ পড়েনি ওটা বেঙ্গার পরিবার। আঘাত স্থবির করে দিয়েছিল তাঁকে।
রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের সৈন্যবাহিনী তখনো ছেড়ে যায়নি বেলজিয়ামের এই উপনিবেশ। প্রথমবার তাদের চোখে পড়েছিল ওটা বেঙ্গা। অদ্ভুত চেহারা দেখে ক্রীতদাস ব্যবসায়ীদের লোভের শিকার হয় ওটা বেঙ্গা। শহুরে জীবনে প্রথমবার প্রবেশ ঘটে এই অরণ্য মানুষের।
কোনমতে জীবন চলছিল তাঁর। পরিবার হারিয়ে নতুন মানুষের ভিড়ে হয়ত মানিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছিল এই অরণ্য মানবের। ১৯০৪ সালে আবার বদলায় তার জীবনের গতিপথ। বিশেষ কাজে আফ্রিকা এসেছিলেন স্যামুয়েল ফিলিপস ভার্নার। তাঁর লক্ষ্য ছিল ' সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ড ফেয়ার'-এর প্রদর্শনীর জন্য বেশ কয়েকজন পিগমিকে নিয়ে যাওয়া। কয়েক বস্তা নুন আর কয়েকগোছা পেতলের তারের বিনিময়ে আরেকবার বিক্রি হয়ে যায় ওটা বেঙ্গা। ১৯০৪ সালের জুন মাসে বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছিল ওটা বেঙ্গাকে।
আমেরিকায় এসেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বেঙ্গা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ দাঁত। আমেরিকার প্রদর্শনীর শেষে বাড়ি ফেরার আর্জি জানিয়েছিলেন ওটা বেঙ্গা। সেই অরন্যের টান। হারিয়ে ফেলা গ্রামের মায়া। আমেরিকার প্রদর্শনীতে নাকি অন্যান্য অনেক উপজাতির মানুষকে আনা হয়েছিল। এক বাচোয়া উপজাতির মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন ওটা বেঙ্গা। কিছুদিনের মধ্যেই সেই মহিলা মারা গিয়েছিলেন সাপের কামড়ে।
শূন্য হাতে আবার আমেরিকা ফিরে আসেন ওটা বেঙ্গা। ১৯০৬ সালে চিড়িয়াখানায় প্রদর্শনীর পর প্রতিবাদ শুরু হয় বিশ্ব জুড়ে।সভ্য মানুষদের জগত বারবার আঘাত করেছিল এই মানুষটিকে। নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাকে নিয়ে। কেউ দাবি করেছেন তিনি জীবন্ত জীবাশ্ম। আবার অমানবিকতার অনেক নজির রয়েছে ওটা বেঙ্গার প্রতি ব্যবহারে।
জীবনের এক অদ্ভুত বাঁকে এসে বদলে যায় বেঙ্গার জীবন। সৌজন্যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ। চিড়িয়াখানায় ওটা বেঙ্গাকে বন্দী করে রাখার একটা অন্যতম কারণ ছিল তাকে মানুষ ও তার পূর্ব পুরুষের মিসিং লিঙ্ক ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদ এই বিশ্বাসের বিরোধী। তাই সমালোচনার মুখে পড়ে অবশেষে ওটা বেঙ্গাকে মুক্তি দেয়া হয় চিড়িয়াখানা থেকে।
মুক্তি পেয়ে প্রথমে তাঁর স্থান হয় নিউ ইয়র্কের এক অনাথ আশ্রম। তারপর কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভার্জিনিয়ায় পড়াশোনা করতেন। দাঁতে ক্যাপ পরে, সভ্য মানুষের অনেক বৈশিষ্ট্যই তখন ওটা বেঙ্গার মধ্যে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সবুজ অরণ্যের স্বাদ ভুলতে পারেননি তিনি। বারবার নিজের অরণ্যের প্রতি ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন পরিচিত মানুষদের কাছে। চেষ্টাও করেছিলেন আরেকবার অরণ্যে ফিরে আসার। কিন্তু ততদিনে শুরু হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আফ্রিকা ফেরার সব জাহাজ তখন বন্ধ ছিল। তাই শেষে অপেক্ষা করেছিল তাঁর জন্য শুধুই বিষন্নতা। অবসাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। শোনা যায় তাঁকে নিয়ে বিতর্কের নানা কথা এখনো ভেসে বেড়ায় সভ্য সমাজের অন্দরে। অমানবিকতা ঢাকতে নানান দোহাই দেওয়া হয়। তবে এই অরণ্য-মানব নিজে কিন্তু কখনো কোনো মানুষকে আঘাত করেননি। তার প্রতি হওয়া অমানবিকতার বদলে তিনি কখনোই ফিরিয়ে দেননি কোন হিংসার প্রকাশ। সময় পাল্টেছে। বদলেছে মানুষের ভাবনা।
নিউইয়র্ক-এর ব্রঙ্কোস চিড়িয়াখানা খুব সম্প্রতি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে ওটা বেঙ্গাকে প্রদর্শিত করার জন্য। কিছু মানুষের জীবন রূপকথার মত হয় না, তাঁরা যন্ত্রণা শুষে নিয়ে শুধু ফিরিয়ে দেয় অবাধ ভালোবাসা আর দ্বেষহীন ভাবনা।