মল্লারপুরের এক শিব মন্দিরের কথা আগের পর্বে আলোচনা হয়েছে। আজ বীরভূমের আরেক শিব মন্দিরের গল্প বলব। তিনি উন্মত্তেশ্বর। তারকেশ্বরের বাবা তারকনাথের মতো মল্লেশ্বর এবং উন্মত্তেশ্বর শিবলিঙ্গও স্বয়ম্ভূ, অখণ্ড এবং অনাদিলিঙ্গ। বীরভূম হল শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলনক্ষেত্র।
উন্মত্তেশ্বরের কথা জানতে হলে জানতে হয় মহাসাধক কৈলাসপতির কথা। এই কৈলাসপতি ছিলেন তন্ত্রসাধক। কথিত আছে, মহাসাধক কৈলাসপতিই হলেন বামাক্ষ্যাপার তন্ত্রগুরু। বলা হয়, তারাপীঠের মহাসাধক বামাক্ষ্যাপাকে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসিয়ে তন্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন কৈলাসপতি। কৈলাসপতি কিন্তু সন্ন্যাসী জীবনের আগে এই বঙ্গেরই সন্তান ছিলেন। তিনি বাংলার ছেলে হলেও তাঁর তন্ত্র শিক্ষা বঙ্গে হয়নি। উত্তর ভারতই হল সাধক কৈলাসপতির সাধন ক্ষেত্র, কিন্তু তিনি বাংলায় ফিরেছিলেন। গুরুর আদেশ পালন করতে বাংলায় এসে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য একলক্ষ টাকা দান করেছিলেন কাশ্মীরের মহারাজা। মন্দিরের নিত্যপুজোর খরচ বাবদ কাশ্মীরের মহারাজা মাসিক ৫০ টাকা মাসহারা বরাদ্দও করেছিলেন তিনি। এই মন্দিরেই বিরাজ করছেন উন্মেত্তশ্বর।
তারাপীঠে দেবী তারার মন্দিরের কয়েক কিলোমিটার দূরেই রয়েছে ডাবুক গ্রাম। সেই ডাবুক গ্রামেই রয়েছে কৈলাসপতি প্রতিষ্ঠিত উন্মেত্তশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরের আরাধ্য দেবতা ডাবুকেশ্বর উন্মত্তেশ্বর দেবাদিদেব মহাদেব। মন্দিরের শিব স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ পাতালভেদী। মাটির নীচে ৪০ গর্ত খুড়েও এই শিবলিঙ্গের তল পাওয়া যায়নি। সাধক বামাক্ষ্যাপাও এই মন্দিরে আসতেন। তিনি এখানকার শিবলিঙ্গের সংস্কার করেছিলেন। পরবর্তীকালে মদন গোঁসাই, পূর্ণানন্দ স্বামী, কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীর মতো অনেকে সাধক সন্ন্যাসী এখানে আসতেন। সাধনা করতেন। তারা প্রায় সকলেই কৈলাসপতির থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। সাধনা করে সিদ্ধিলাভও করেন।
মন্দিরের উন্মত্তেশ্বর শিবের প্রতিদিন অন্নভোগ হয়। মন্দিরে দেবী তারার মূর্তিও রয়েছে। এখানে দেবী তারাকেও অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। বলা হয়, উন্মত্তেশ্বর আসলে দেবী তারার ভৈরব। এই মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে বিশেষ পুজো ও উৎসব পালিত হয়। এছাড়াও শ্রাবণ ও চৈত্র মাসে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পুজো হয়। বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। ভক্তদের বিশ্বাস এখানকার শিব অত্যন্ত জাগ্রত। শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালতে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। বহু সাধক ও সন্ন্যাসী এই মন্দিরে নিত্য যাতায়াত করেন। বহু সাধক এই মন্দিরে শৈব সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। ডাবুকের এই মন্দির এক শৈবতীর্থ, মনস্কামনা পূরণের জন্য এই মন্দিরে সারাবছর দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন।
আবার মল্লারপুরের অনতিদূরেই রয়েছে গণপুর, বহু প্রাচীন এককালের বর্ধিষ্ণু এক গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে পঁয়তাল্লিশটি শিব মন্দির। কোনও গ্রামাঞ্চলে এমন অলংকৃত ও কারুকার্যমণ্ডিত শিব মন্দির খুব একটা চোখে পড়ে না। গণপুর গ্রামের একেবারে মাঝে কালীতলায় রয়েছে ১৪টি চারচালা শিব মন্দির, তার পূর্ব দিকে ৭টি, পশ্চিম দিকে ৪টি, উত্তরে ৩টি এবং একটি সুউচ্চ দোলমঞ্চ, দক্ষিণে একটি অর্ধবৃত্তাকার মন্দির রয়েছে। মাত্র চারটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠার সন উৎকীর্ণ আছে। কালীতলার দক্ষিণে আরও ৫টি টেরাকোটার কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির রয়েছে। ১৪টি চারচালা শিব মন্দিরের সামনের দিকে রাম-রাবণের যুদ্ধ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, যুধিষ্ঠির-শকুনির পাশা খেলা, কাঠচেরাই, মহিষমর্দিনী দুর্গা ইত্যাদি বিভিন্ন মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। মন্দিরগুলির মধ্যে বেশ কিছু মন্দির দুশো-আড়াইশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। এখানেই রয়েছে আটচালা বিশিষ্ট বৃহৎনারায়ণ মন্দির। এই গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবার চৌধুরিরা ছিলেন শৈব। কথিত আছে, এক সময় দুর্ভিক্ষের কারণে গ্রাম উজাড় হতে বসেছিল। গ্রামবাসীদের অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে চৌধুরি পরিবার মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ঘটনাটা আঠারো শতকের। মন্দিরগুলি তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১২ বছর। ১৭৬৭ থেকে ১৭৭৯-এর মধ্যে মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছিল। এখানেই রয়েছে শিব পাহাড়ি। কালাপাহাড়ের স্মৃতি বিজোড়িত শিব রয়েছে এখানে। শিবের নাম শ্রীশ্রী বাবা সিদ্ধিনাথ। কথিত আছে, জয়দ্রথ এখানে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিল বলে শিবের নাম হয়েছে সিদ্ধিনাথ।
ছবিঃ প্রতীকী